
তরুণদের অনেকেই এখন প্রথাগত অফিসের চাকরি ছেড়ে নিজের সময় ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলছেন বিকল্প পেশাজীবন। তারা পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন ‘ফ্রিল্যান্সিং’। তবে শব্দটা শুনলে খুব ‘স্বাধীন’ গোছের কিছু একটা মনে হলেও, এতে দায়িত্বেরও ব্যাপার রয়েছে।
অফিসের চাকরির সঙ্গে এই কাজের মৌলিক কিছু পার্থক্য থাকলেও, দায়িত্বের জায়গায় কোনো অবহেলার সুযোগ নেই। ফলে যারা নিজেদের ক্যারিয়ার ফ্রিল্যান্সিংয়ে থিতু করতে চান, তাদের জন্য লেখাটি নির্দেশনা স্বরূপ কাজে লাগবে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
বিশ্বব্যাপী ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীজুড়ে প্রায় ২৮ শতাংশ দক্ষ পেশাজীবী এখন স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। যারা বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত, তাদের এক-তৃতীয়াংশও ভবিষ্যতে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করবেন ভাবছেন। বাংলাদেশেও দ্রুত বাড়ছে এই সংখ্যা। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ছয় লাখ ছাড়িয়েছে।
লক্ষ্য নির্ধারণ করুন
ফ্রিল্যান্সিং শুরু করার আগে নিজের লক্ষ্য স্পষ্ট করুন। আপনি কি চাকরির পাশাপাশি বাড়তি আয় করতে চান, নাকি পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান? পার্টটাইম হিসেবে শুরু করলে ঝুঁকি কমে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন সহজ হয়। আর যদি পূর্ণকালীন ফ্রিল্যান্সিংয়ের পথে যেতে চান, তবে আর্থিক পরিকল্পনা, কাজের লক্ষ্য ও আয়-ব্যয়ের হিসাব আগে থেকেই নির্ধারণ করা জরুরি।
বাজারের চাহিদা
সব কাজ সবসময় সমান জনপ্রিয় থাকে না, সব দক্ষতাও সবসময় প্রয়োজন হয় না। বিশেষ করে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এখন অনেক কাজের ধরন বদলে দিয়েছে। তাই কোন ক্ষেত্রগুলোতে ফ্রিল্যান্সারদের কাজের চাহিদা বাড়ছে তা জেনে রাখা দরকার। Upwork, Fiverr ev LinkedIn-এ নজর রাখুন-সেখানে ভিডিও এডিটিং, কনটেন্ট রাইটিং, ডেটা অ্যানালিটিকস এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজ পাওয়া যায়। এআই-কে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেও অনেক কাজ করা যায়। মোটাদাগে, বিশ্ববাজারের চাহিদা বুঝে নিজেকে তৈরি করতে পারলেই আপনি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন।
ভালো লাগার কাজ বেছে নিন
ফ্রিল্যান্সিংয়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো-আপনি নিজের পছন্দের কাজ ও সময় বেছে নিতে পারেন। তবে কেবল টাকার চিন্তা করে কাজ বেছে নিলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যেটা করতে আনন্দ পান, সেই কাজেই সময় দিন। লেখালেখি ভালো লাগলে কনটেন্ট রাইটিং বা কপিরাইটিং, ডিজাইন পছন্দ হলে গ্রাফিক
ডিজাইন বা ইউএক্স-ইউআই ডিজাইন শেখা শুরু করতে পারেন। নিজের আগ্রহের জায়গায় কাজ করলে শেখার গতি বাড়ে, কাজেও সৃজনশীলতা আসে।
ধীরেসুস্থে শুরু করুন, স্থির থাকুন
ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফলতা একদিনে আসে না। অনেকেই চাকরি ছেড়ে একেবারে পুরোপুরি ফ্রিল্যান্সিংয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন-এটা ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে। প্রথম দিকে কাজের সংখ্যা ও আয়ে ওঠানামা থাকবে। তাই প্রথম কয়েক মাস চাকরির পাশাপাশি পার্টটাইম হিসেবে কাজ শুরু করা ভালো। এতে বাস্তব অভিজ্ঞতা হবে, বাজার বোঝা যাবে, ক্লায়েন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করার দক্ষতাও বাড়বে।
কিছু নিয়মকানুনও জানতে হবে
ফ্রিল্যান্সিং মানে আপনি নিজেই নিজের প্রতিষ্ঠানের সিইও। তাই চুক্তি, দাম নির্ধারণ, ইনভয়েস পাঠানো-সব কিছুতে সচেতন হতে হবে। কাজের শর্ত লিখিতভাবে রাখুন, সময়মতো কাজ জমা দিন এবং পেশাদার আচরণ বজায় রাখুন। নিজের আয়-ব্যয়ের রেকর্ড রাখুন। এগুলো আপনার পেশাদারিত্বের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করবে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ফ্রিল্যান্সিংয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো-অবস্থান কোনো বাধা নয়। সুনামগঞ্জ, রংপুর বা কুষ্টিয়া বসেও কেউ লন্ডন বা নিউইয়র্কের ক্লায়েন্টের জন্য কাজ করতে পারেন। তাই দক্ষতার পাশাপাশি দরকার সময় ব্যবস্থাপনা, ইংরেজি ভাষায় লেখা ও কথা বলার দক্ষতা, আর ক্রমাগত শেখার মানসিকতা। পাশাপাশি বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্র হবে ‘মাইক্রোশিফটিং’-অর্থাৎ মানুষ একসঙ্গে একাধিক ছোট প্রকল্পে কাজ করবে এবং নিজের দক্ষতা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ভাগ করে দেবে।
এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য এখন থেকেই প্রস্তুত থাকা জরুরি। ফ্রিল্যান্সিং মানে স্বাধীনভাবে কাজ করা হলেও, এতে দায়িত্বে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। যথাযথভাবে কাজ করলেই ফলাফল আসে। তাই পরিকল্পনা, অধ্যবসায় ও পেশাদারিত্ব থাকলে এই খাত হতে পারে টেকসই ক্যারিয়ারের নতুন দিগন্ত। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন-আপনি কি নিয়মিত চাকরির পাশাপাশি স্রেফ কিছু বাড়তি আয় চান, নাকি ফ্রিল্যান্সিংয়েই নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ খুঁজছেন? নিজের লক্ষ্যকে জানুন, বুঝুন, সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিন।