
দেশে দেড় দশক ধরে চলমান গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি এখন প্রকট সংকটে পরিণত হয়েছে। গত ৯ বছর ধরে স্থানীয় উত্পাদন টানা কমতে থাকায় স্থানীয় শিল্পে ও আবাসিক খাতে গ্যাসের চাহিদাও স্বাভাবিক গতিতে বাড়েনি। নিম্নগতির প্রবৃদ্ধির মধ্যেও রাজধানীসহ দেশে দৈনিক যে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে, তার মাত্র ৬০ শতাংশের মতো সরবরাহ করতে পারছে সরকারের বিতরণ কোম্পানিগুলো। এমন পরিস্থিতিতে আবাসিক, শিল্প, সার ও পরিবহণসহ বিভিন্ন খাতের গ্রাহকদের ভোগান্তি ও দুশ্চিন্তা বেড়েছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, পেট্রোবাংলা এবং শিল্প খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দেশে বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৪২০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সরবরাহ করা যাচ্ছে ২৫০-২৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। সর্বশেষ গত বুধবার ২৫৩ দশমিক ৪ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। অর্থাত্ চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ফলে অধিকাংশ বাসাবাড়িতে রান্নার চুলা জ্বলছে নিভু নিভু। অর্ধেকের মতো শিল্পকারখানা পূর্ণ সক্ষমতায় চলছে না। বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাবসায়িক টানাপড়েনের মধ্যে জ্বালানি-সংকটের কারণে কারখানা বিক্রি করে দিতেও বাধ্য হয়েছেন ও হচ্ছেন অনেকে। অনেক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তিতাস গ্যাস কোম্পানিসহ বিতরণকারী সংস্থাগুলোর সূত্র জানায়, দেশে গত চার বছর ধরে প্রতি বছর ১৫-২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন কমছে। দেশে গ্যাসের উত্পাদন ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়া, আর্থিক সংকটে এলএনজি আমদানি কমানো এবং আগের যে কোনো সময়ের চাইতে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে বর্তমানে দেশে গ্যাসের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। পেট্রোবাংলার গ্যাস উত্পাদন ও বিতরণ রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে এবং খাত সংশ্লিষ্টদের মূল্যায়নে জানা যায়, দেশে এখন দৈনিক গ্যাসের চাহিদা অন্তত ৪২০ কোটি ঘনফুট। গত প্রায় এক বছর ধরে ৩০০ কোটি সরবরাহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা না গেলেও দৈনিক ৩৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস বিতরণ করা গেলেও গ্রাহক পর্যায়ে পরিস্থিতি মোটামুটি সহনীয় থাকে।
বর্তমানে দেশজ গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দিনে গড়ে ১৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়। ২০১৭ সালে তা ছিল ২৭০ কোটি ঘনফুটের মতো। অর্থাত্ দেশীয় গ্যাসের উত্তোলন ৩৩ শতাংশ কমেছে। বিদ্যমান এলএনজি অবকাঠামো দিয়েও দৈনিক গড়ে ১০০ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস সরবরাহ সম্ভব নয়। অর্থাত্ বর্তমান সক্ষমতায় ২৮০ কোটির ঘনফুটের বেশি গ্যাস সরবরাহ কঠিন। এরপর কখনো স্থানীয় উত্পাদনও গড়ের চেয়ে কমে যায়, এলএনজি আমদানিও গড়ের চেয়ে হ্রাস পায়। তখন সংকট বাড়ে। যেমন গত প্রায় এক বছর দেশে সর্বোচ্চ পরিমাণে এলএনজি আমদানি হলেও বর্তমানে দৈনিক এলএনজি থেকে গ্যাস সরবরাহ ৯০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমেছে। ফলে সংকট আরেকটু বেড়েছে। সব মিলিয়ে স্থানীয় গ্যাস উত্পাদন তলানিতে পৌঁছে যাওয়ায় এবং এলএনজি আমদানির অবকাঠামো ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকায় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ শিগিগরই সম্ভব নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গ্যাস-সংকটের কারণে শিল্পকারখানার উত্পাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে উত্পাদন ব্যয় বেড়েছে। বাসাবাড়িতে পাইপলাইনে গ্যাস না পাওয়ার কারণে খরচ বেড়েছে। বিকল্প হিসেবে অনেক শিল্পোদ্যোক্তা সম্প্রতি উচ্চ মূল্যের এলপিজি ও সিএনজি কারখানায় ব্যবহার শুরু করেছেন। আবাসিক খাতের অবস্থাও একই। রাজধানীর অনেক এলাকার বাসিন্দাদের খাবার হোটেল থেকে এনে খেতে হচ্ছে। অনেকেই আবার বাসাবাড়িতে বিকল্প হিসেবে পাইপলাইনের গ্যাস-সংযোগ থাকার পরও এলপিজি বা বোতল গ্যাস ব্যবহার করছেন। ব্যবহার করছেন ইলেকট্রিক বা কেরোসিনের চুলাও। আর রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে সিএনজি রিফিলিং স্টেশনগুলোতে অপেক্ষমাণ গাড়ির সারি বড় হচ্ছে।
শিল্প খাতের কয়েক জন উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তা জানান, ঢাকার উত্তর অংশসহ আশুলিয়া, সাভার, জয়দেবপুর, সফিপুর, কাশিমপুর, কোনাবাড়ী, টাঙ্গাইল, এলেঙ্গা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় তীব্র গ্যাস-সংকট রয়েছে। ঐ এলাকাগুলোর বেশ কিছু পোশাককারখানায় গ্যাসের চাপ প্রতি বর্গইঞ্চিতে ৩-৪ পিএসআইতে নেমে এসেছে। সাধারণত জেনারেটর বা বয়লার চালানোর জন্য পোশাককারখানাগুলোয় ১৫ পিএসআই চাপের গ্যাস প্রয়োজন। অনেক কারখানায় এ চাপ ৭ থেকে ১০ পিএসআইয়ে নেমে আসায় ধুঁকে ধুঁকে চলছে গ্যাসচালিত মেশিনের কারখানাগুলো। এতে শিল্পকারখানায় উত্পাদন ব্যাহত হচ্ছে ব্যাপকভাবে।
আবাসিকে গ্যাস-সংকটের কারণে বেশি বিপাকে পড়েছে সীমিত আয়ের মানুষ ও তাদের পরিবারগুলো। সামর্থ্যবান অনেকেই পাইপলাইনে গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলপি গ্যাস ব্যবহার করছেন। এতে করে জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। রাজধানীর রায়েরবাগ, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডির একাংশ, গ্রিনরোড, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, মুগদা, আরামবাগ, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, মহাখালী, পল্লবী, কাফরুল, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০, রামপুরা, মগবাজার, মালিবাগ, রামপুরা এবং লালবাগ এলাকার গ্রাহকরা গ্যাস-সংকটের তথ্য জানিয়েছেন। ঢাকার বাইরেও আবাসিক খাতে গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির তথ্য রয়েছে। এদিকে রাজধানীসহ মহাড়কগুলোর পাশে সিএনজি রিফিলিং স্টেশনগুলোতেও সিএনজির জন্য প্রাইভেট কার ও অটোর দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে।
জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি দুইটি গ্যাসকূপ সংস্কার করে স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহ কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে ৫০টি ও ২০২৬-২৮ সালের মধ্যে ১০০টি কূপ খনন ওয়ার্কওভার কর্মপরিকল্পনাসহ দেশের বিভিন্ন ব্লকে অনুসন্ধান ও নতুন কূপ খননের কাজ জোরদার করা হয়েছে। তবে পুরোনো কূপে গ্যাস অনুসন্ধান করে গ্যাস পাওয়া গেলেও তা পরিমাণে খুব বেশি আসবে না। ঘাটতি কিছুটা কমানো যাবে। অন্যদিকে নতুন কূপে গ্যাস পেলে সেটি উত্তোলন করে গ্রিডে আনতে কয়েক বছর সময় লেগে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে এলএনজি টার্মিনাল দক্ষতার সঙ্গে দ্রুত নির্মাণ করলে বছর দেড়েকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সরবরাহ বাড়বে। তবে তাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ার আশঙ্কা আছে। এর পরও স্থানীয় উত্পাদন ও আমদানির সমন্বয় করে সংকট কমানোর বিষয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এক্ষেত্রে নীতি সমন্বয়, প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যত জোর দেবে, তত দ্রুত সংকট কমতে পারে। তবে বাস্তবতা হলো—পরবর্তী সরকারের প্রথম তিন বছরে যদি চাহিদা না-ও বাড়ে, তাতেও বিদ্যমান ঘাটতি সহনীয় মাত্রায় আনতে কমপক্ষে তিন বছর লাগবে।