
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অনেক ঠিকাদার পালিয়েছেন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় শতাধিক প্রকল্পের ঠিকাদার কাজ না করে পালিয়ে গেছেন। এর মধ্যে অনেক ঠিকাদার টাকাও তুলে নিয়ে গেছেন। যেসব প্রকল্পে ঠিকাদাররা পালিয়েছেন সেসব প্রকল্পে নতুন করে দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
সম্প্রতি ২০২৪-২৫ ও ২০২৫-২৬ অর্থবছরের (এডিপি) বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় জানানো হয়, অনেক কর্মকর্তা প্রকল্প পরিচালক বা পিডি হতে চাচ্ছেন না। এ জন্য প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ও বদলিতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরেও গতি ফিরেনি এডিপি বাস্তবায়নে। নতুন ২০২৫-২৬ অর্থবছর শুরুর প্রথম দুই মাস অর্থাত্ জুলাই-আগস্ট সময়ে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ের ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ থেকেও কম। গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদার পালিয়ে যান। ফলে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ঐ সময়ের এডিপি বাস্তবায়নের চিত্রে এর প্রভাব ফুটে ওঠে। চলতি অর্থবছরে কোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকা সত্ত্বেও এডিপি বাস্তবায়নের চিত্র ভালো নয়। এর পেছনে মূলত দুটি কারণ সভায় জানানো হয়েছে। একটি হচ্ছে যেসব প্রকল্পের ঠিকাদার পালিয়ে গেছেন, সেগুলোর কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে, অন্যদিকে অনেক প্রকল্পে পিডি নেই। এর ফলে উন্নয়ন ব্যয়ে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। এতে বোঝা যায় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাঠামোগত সমস্যাগুলো রয়ে গেছে।
সভায় প্রকল্প বাস্তবায়ন, ব্যবস্থাপনায় সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হয়। এ সময় বেশ কিছু প্রস্তাব পেশ করা হয়। এর মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এ জন্য জনবলের দক্ষতা বাড়ানো, ডিপিপি প্রণয়নে সংস্থা পর্যায়ে বাজেট বরাদ্দ, ডিপিপি প্রণয়নের শুরু থেকেই ফোকাল পার্সন নিয়োগ এবং পরে তাকেই প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, গত অর্থবছরের শুরুতে জুলাই আন্দোলনকে ঘিরে দেশে উন্নয়ন কাজও বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু চলতি অর্থবছরে কোনো সমস্যা না থাকলেও কাজে গতি আসছে না। প্রকল্প পরিচালক হতে আগে বিভিন্ন সময়ে কর্মকর্তাদের আগ্রহ থাকলেও এবার তা দেখা যাচ্ছে না। প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েও অনেকে কাজে যোগ দেয়নি। পরিকল্পনা উপদেষ্টাও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ সব নিয়ে কথা বলেছেন। গেল একনেক সভা শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা জানিয়েছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করেছি। ফলে প্রকল্প পরিচালক হতে কর্মকর্তারা কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তবে অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা দূর করতে সব প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়া অনলাইনে করা হবে। এতে করে গুটিকয়েক ‘মাফিয়া’ প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য বন্ধ হবে, উল্লেখ করেন তিনি। ক্রয় আইন পরিবর্তন হলে নতুন ঠিকাদারেরা কাজ করার সুযোগ পাবেন। দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসবে বলেও জানা যায়।
অবশ্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ক্রয়বিধিমালার অপেক্ষায় রয়েছে মন্ত্রণালয়গুলো। বিশেষ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ সংস্থাটি দরপত্র দিচ্ছে না। কারণ হিসেবে তারা বলছে, যেসব ঠিকাদার পালিয়েছে, নতুন দরপত্র দিলে তারা বেনামে দরপত্র বাগিয়ে নেয়। নতুন ক্রয়নীতির গেজেট হলে পালিয়ে যাওয়া ঠিকাদারদের এ সুযোগ থাকবে না।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, সভায় আলোচিত প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে: প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) জন্য পরিকল্পনা প্রক্রিয়া, সরকারি অর্থব্যবস্থাপনা এবং সরকারি ক্রয়বিধি-২০০৮ বিষয়ে সার্টিফিকেশন কোর্স চালুর প্রস্তাব। এছাড়া কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে পিডিদের পুরস্কৃত করার এবং নিয়োগ ও বদলিতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন প্রস্তাবও করা হয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়নের জন্য সংস্থা পর্যায়ে জনবলের দক্ষতার বৃদ্ধির প্রস্তাব এসেছে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায়। এছাড়া ডিপিপি প্রণয়ন বাবদ সংস্থাগুলোকে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ এসেছে। প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন কার্যক্রম শুরুর সময় থেকেই প্রকল্পে ফোকাল পার্সন নিয়োগ এবং তাকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে।
মানসম্মত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রণয়নের জন্য পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল/প্রতিষ্ঠান নিশ্চিতকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুমোদনের পূর্বে স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দ্বারা মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবও এসেছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বাজার জরিপ, চাহিদা পূর্বাভাস, ঝুঁকি বিশ্লেষণ, পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন পৃথক অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
কর্মকর্তারা জানান, সভায় উন্নয়ন প্রকল্প তদারকি ওপর বিশেষ জোর দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে। এ লক্ষ্যে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) কার্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া খাত-ভিত্তিক অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদনের বিষয়েও সভায় আলোচনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।