
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহবাজ শরিফ যখন গত সপ্তাহে রিয়াদে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে আলিঙ্গন করলেন, তা কেবল সৌজন্যপূর্ণ সাক্ষাৎই ছিল না—এর মধ্যে কূটনৈতিক বার্তা ছিল স্পষ্ট। একই দিনে দুই দেশ একটি ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’ স্বাক্ষর করলো, যা ইসলামী বিশ্বের একমাত্র পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রকে উপসাগরীয় অঞ্চলের শক্তিশালী রাজতন্ত্রের সঙ্গে আরও কাছাকাছি নিয়ে গেছে।
সৌদি এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এই চুক্তি মূলত দীর্ঘদিনের সহযোগিতার আনুষ্ঠানিকীকরণ। তবে ভারতের অনেক বিশ্লেষক এটি ভিন্নভাবে দেখছেন। ভারতের সঙ্গে সৌদির সম্পর্ক যতটা মধুর, পাকিস্তানের সঙ্গে বর্তমান উত্তেজনার কারণে এই চুক্তি নয় ভেবেই হয়নি।
ভারতীয় বিশ্লেষকরা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন এই অংশটি নিয়ে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘যেকোনো আক্রমণ উভয় দেশের বিরুদ্ধে হলে তা উভয়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসেবে গণ্য হবে’।
ভারতের কৌশলবিদ ব্রহ্মা চেলানী মন্তব্য করেছেন, এই চুক্তি অর্থনৈতিক সংকটের মুখে থাকা পাকিস্তানের শক্তি দেখায় না, বরং সৌদির উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করে।
ভারতের সাবেক বিদেশ সচিব কনওয়াল সিবাল এই চুক্তিকে ‘ভীতিকর ভুল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পাকিস্তানকে নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে ধরা বিপজ্জনক বলে সতর্ক করেছেন সৌদি আরবকে।
ভারতের সরকার কিছুটা সংযত মনোভাব নিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চুক্তির প্রভাব তারা ‘জাতীয় নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার’ দিক থেকে মূল্যায়ন করবে। ভারতের সঙ্গে সৌদি আরবের কৌশলগত অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে পারস্পরিক স্বার্থ ও সংবেদনশীলতা মাথায় রাখা হবে।
কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, ভারত হয়তো ঝুঁকি অতিরঞ্জিত করছে। সৌদি আরব ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায় কারণ, ভারত তার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং প্রধান তেলের ক্রেতা। মাইকেল কুগেলম্যান মনে করান, চুক্তি সরাসরি ভারতের জন্য কোনো বাধা সৃষ্টি করে না। সৌদি ভারত-বিরোধী কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেবে না।
তবু চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানকে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা কাঠামোর অংশ করা হলে, ভারতের জন্য এটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পাকিস্তান এখন তিনটি বড় শক্তি—চীন, তুরস্ক এবং সৌদি আরবের—সহ সমর্থিত অবস্থানে।
সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৯৬০-এর দশক থেকে দুই দেশের সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। পাকিস্তানিরা সৌদি সেনাবাহিনী গঠন ও প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে সৌদি অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা পাকিস্তানের পাশে ছিল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই চুক্তি কেবল সামরিক প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি বার্তা বহন করে। এটি সৌদির নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব বৈচিত্র্যময় করার সংকেত দেয়, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা বজায় থাকে। পাকিস্তানের পরমাণু শক্তি সৌদিকে একটি প্রতিরক্ষা ‘বিমা’ প্রদান করে।
ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ কূটনৈতিক ও আঞ্চলিক। এটি একটি বিস্তৃত জোটের ভিত্তি তৈরি করতে পারে, যা ভারতের ‘লুক ওয়েস্ট’ নীতি ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে জটিল করতে পারে। পাকিস্তানের জন্য এটি সৌদির আর্থিক ও রাজনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে সামরিক শক্তি বাড়ানোর সুযোগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুক্তি সরাসরি নিরাপত্তার জন্য ভারতের জন্য হুমকি না হলেও কূটনৈতিকভাবে এটি ভারতের জন্য অনুকূল চিত্র তৈরি করে না। ভারতের সরকার এখন সাবধান চোখ রাখছে, পরিস্থিতি কিভাবে এগোবে তা দেখার অপেক্ষায়।