
পদত্যাগের মাত্র চার দিন পরই সেবাস্তিয়ান লেকর্নুকে আবারও ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।
২৭ দিন দায়িত্বে থাকার পর সোমবার (৬ অক্টোবর) ৩৯ বছর বয়সী লেকর্নুর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়। শুক্রবার (১০ অক্টোবর) এক বিবৃতিতে ম্যাক্রোঁর দপ্তর জানিয়েছে, লেকর্নুকে এখন নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এই পুনর্নিয়োগকে ফ্রান্সের রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের জন্য এক চমকপ্রদ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত কয়েক দিন ধরে প্রেসিডেন্ট ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা আলোচনা চলছিল সমাধান খুঁজে বের করতে।
এক্স (সাবেক টুইটার)-এ দেওয়া এক পোস্টে লেকর্নু লেখেন, ‘রাষ্ট্রপতি যে দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করেছেন, তা আমি কর্তব্যবোধ থেকে গ্রহণ করছি। বছরের শেষ নাগাদ ফ্রান্সের জন্য একটি বাজেট পাস করা এবং নাগরিকদের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই রাজনৈতিক সংকট এবং ফ্রান্সের ভাবমূর্তি ও স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর অস্থিতিশীলতার ইতি টানতে হবে।’
পদায়নের পর আল জাজিরার প্যারিস প্রতিবেদক নাটাশা বাটলার বলেন, ‘ফরাসি রাজনীতিতে গত কয়েক দিন এতটাই অস্থির ছিল যে কেউই অনুমান করতে পারছিল না কী হতে যাচ্ছে। এই নিয়োগই প্রমাণ করে, এটি ছিল নাটকীয় এক সপ্তাহের সর্বশেষ মোড়।’
শুক্রবার ম্যাক্রোঁ চরম দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল র্যালি (আরএন) ও বামপন্থী ফ্রান্স আনবাউড বাদে অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে এলিসি প্রাসাদে বৈঠক করেন। বৈঠকের আগে প্রেসিডেন্টের দপ্তর এক বিবৃতিতে সব রাজনৈতিক দলকে ‘সমষ্টিগত দায়িত্বের মুহূর্ত’ হিসেবে বিষয়টি স্বীকার করতে আহ্বান জানায়। এতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, যদি ম্যাক্রোঁর পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন না দেওয়া হয়, তবে তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে পারেন।
বাটলার বলেন, লেকর্নুর পুনর্নিয়োগ দেখাচ্ছে যে ‘ম্যাক্রোঁর হাতে এখন বিকল্প ফুরিয়ে গেছে’।
বৈঠকের পর কয়েকজন দলীয় নেতা জানান, তারা মনে করছেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ তাদের উদ্বেগ বুঝতে পারছেন না, আলোচনাগুলো বরং পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে।
এক মাস আগে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়া লেকর্নু সম্প্রতি বাজেট সংকটের মধ্যে ভগ্নাংশ পার্লামেন্টে বিল পাস করাতে না পারায় ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছিলেন।
এখন তার প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে নতুন সরকার গঠন করা এবং সংবিধান অনুযায়ী সোমবারের মধ্যে ২০২৬ সালের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা, যাতে বছরের শেষের আগে ভগ্নাংশ পার্লামেন্টে তা ভোটে তোলা যায়।
বাটলারের বিশ্লেষণে, লেকর্নুর সামনে বড় সমস্যা হলো—এমনকি ডানপন্থার অনেক রাজনীতিবিদও এখন তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অনিচ্ছুক। ফলে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য তার ‘খুব সীমিত পরিসর’ থাকবে।
‘সংযোগহীন’ ম্যাক্রোঁর সিদ্ধান্তে সমালোচনার ঝড়
লেকর্নুকে পুনর্নিয়োগের মাধ্যমে ম্যাক্রোঁ এমন এক ঝুঁকি নিয়েছেন, যা তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ক্ষুব্ধ করতে পারে। তারা মনে করছেন, ফ্রান্সের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গভীর রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হতে পারে হয় পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া, নয়তো প্রেসিডেন্টের নিজ পদত্যাগ।
রাজনৈতিক পরিসরের বিভিন্ন দলই লেকর্নুর পুনর্নিয়োগের কড়া সমালোচনা করেছে।
চরম দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল র্যালি (আরএন) দল ঘোষণা করেছে, তারা অবিলম্বে লেকর্নু নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারকে ‘আস্থা ভোটের মাধ্যমে’ নামানোর উদ্যোগ নেবে। দলটির নেতা জর্ডান বারডেলা বলেছেন, ‘একজন বিচ্ছিন্ন ও বাস্তবতা থেকে সংযোগহীন ম্যাক্রোঁর এই সিদ্ধান্ত একেবারে “খারাপ রসিকতা”। আমরা এই সরকারের বিরুদ্ধে অবিলম্বে অনাস্থা প্রস্তাব আনব, কারণ এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’
ফরাসি সমাজতান্ত্রিক পার্টির সদস্য ফ্রাঁসোয়া কালফোঁ বলেন, ‘আমাদের সংশয় প্রতিদিনই বাড়ছে। আমরা পেনশন সংস্কারের বিষয়ে স্পষ্ট পদক্ষেপ চাই। প্রয়োজনে আবারও নির্বাচনে যেতে আমরা ভয় পাই না।’
বামপন্থী ফ্রান্স আনবাউড দলের সংসদীয় নেতা ম্যাথিল্ড পানো বলেন, ‘কোনো প্রেসিডেন্ট কখনও এতটা ঘৃণা ও বিরক্তি নিয়ে শাসন করতে চাননি। যিনি সোমবার পদত্যাগ করেছেন, তাকে শুক্রবারই পুনর্নিয়োগ করা হয়েছে। ম্যাক্রোঁ কেবল নিজের পতন কিছুটা পিছিয়ে দিচ্ছেন।’
তবে জাতীয় পরিষদের স্পিকার ইয়েল ব্রাউন-পিভে তুলনামূলক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘সেবাস্তিয়ান লেকর্নুর পুনর্নিয়োগ আমি লক্ষ্য করেছি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জাতীয় পরিষদ কাজের জন্য প্রস্তুত—বিতর্ক, পর্যালোচনা ও ভোটের জন্য। এখন কাজ শুরু করার সময়। অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
ফরাসি রাজনীতিতে অচলাবস্থার সূচনা হয় গত বছর, যখন ম্যাক্রোঁ ক্ষমতা সুসংহত করতে আগাম নির্বাচনের ঝুঁকি নেন। কিন্তু ফল হয় উল্টো—গঠিত হয় ঝুলন্ত পার্লামেন্ট এবং বাড়ে চরম দক্ষিণপন্থীদের আসন সংখ্যা।