
কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে চলা হিমালয় অঞ্চলের দেশ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর রাস্তায় টহল মোতায়েন করেছে সেনাবাহিনী। গত মঙ্গলবার সেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতায় রূপ নেয়। রাজনীতিবিদদের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়, সরকারি ভবন ও পার্লামেন্টে আগুন দেওয়া হয় এবং এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। দুই দিনের সহিংসতায় ৩০ জনের বেশি নিহত এবং এক হাজারেরও বেশি আহতের খবর পাওয়া গেছে।
বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেওয়া ‘জেনারেল জেড’ বা জেন-জি তরুণরা ধ্বংসযজ্ঞ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়ে বলেছে, ‘সুবিধাবাদীরা’ তাদের বিক্ষোভ তাদে ‘হাইজ্যাক’ করেছে।
বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) কাঠমান্ডুর বিমানবন্দর পুনরায় খুলে দেওয়া হয় এবং রাজধানী তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল। বেশিরভাগ বাসিন্দা কারফিউ মেনে চলছেন, কিন্তু জ্বলন্ত ভবন থেকে এখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা সামরিক বাহিনী জেন-জি বিক্ষোভকারীদের শান্তি আলোচনায় যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। জেন-জিদের একজন প্রতিনিধি বিবিসিকে জানিয়েছেন, ছাত্রনেতারা দাবির একটি নতুন তালিকা তৈরি করছে।
আজ বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত দেশব্যাপী কারফিউ জারি রয়েছে। সেনাবাহিনী সতর্ক করে জানিয়েছে, সহিংসতা ও ভাঙচুর করলে শাস্তি দেওয়া হবে। সহিংসতা ও লুটপাটের ঘটনায় ২৭ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে এবং ৩১টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
রাজধানীজুড়ে সামরিক চেকপয়েন্টগুলোতে অফিসাররা যানবাহনের আইডি চেক করছেন এবং লোকেদের বাড়িতে থাকার জন্য অনুরোধ করছেন। লাউডস্পিকারে ভেসে উঠছে – ‘অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ করবেন না’।
তবুও কিছু তরুণকে বাইরে দেখা যায়। তাদের হাতে বিন লাইনার দেখা যায় এবং মুখে ছিল মুখোশ। তারা বিক্ষোভের পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় ব্যস্ত।
বিক্ষোভে যোগ না দেওয়া ১৪ বছর বয়সী ক্ষ্যাং লামা বলেন, ‘দুর্নীতির বিষয়টি নেপালে অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। আমার মনে হয় জাতির পরিবর্তনের এখনই সময়। আমি সত্যিই আশা করি এটি (জেন-জি আন্দোলন) আমাদের দেশে ইতিবাচক কিছু বয়ে আনতে পারবে।’
২৪ বছর বয়সী পরশ প্রতাপ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেন, নেপালের ‘স্বাধীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন’ এবং কাঠমান্ডুর মেয়র বলেন্দ্র শাহকে একজন ভালো নেতা।
৩৬ বছর বয়সী রাকেশ নিরাউলা বলেন, ‘এই বিপ্লবের পর মানুষ এখন আশাবাদী। আরও ভালো শাসনব্যবস্থার আশা আছে। আমরা মনে করি, এটি নেতাদের জন্য নিজেদের উন্নত করার একটি শিক্ষা ছিল, যাতে দেশ উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ লাভ করতে পারে।’
পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে স্বাগত জানালেও কিছু নেপালি বিবিসিকে বলছেন, বিক্ষোভের সময় ঘটে যাওয়া সহিংসতা এবং ভাঙচুর তাদের অবাক করে দিয়েছে। নিরাউলা নামের একজন বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি এটা হওয়া উচিত হয়নি।’
ললিতপুর শহরে বসবাসকারী একজন উদ্যোক্তা প্রভাত পাউডেল বলেন, সুপ্রিম কোর্টের মতো সরকারি ভবন পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় তিনি হতবাক।
কিছু বিক্ষোভকারী উদ্বিগ্ন যে, এই আন্দোলন ‘অনুপ্রবেশকারী’ মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে – সেনাবাহিনীও এই দাবির প্রতিধ্বনি করেছে।
সামরিক মুখপাত্র রাজারাম বাসনেট বিবিসিকে বলেন, আমরা মূলত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে লুটপাট, আগুন লাগানো এবং বিভিন্ন ঘটনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় আছি।
বিক্ষোভকারীদের জারি করা একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আন্দোলন অহিংস ছিল এবং এখনো তাই আছে। শান্তিপূর্ণ নাগরিক সম্পৃক্ততার নীতি এটি হচ্ছে।
তারা আরও জানিয়েছে, গতকাল বুধবার থেকেই আর কোনো বিক্ষোভের পরিকল্পনা করা হয়নি। প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে কারফিউ বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিক্ষোভের কারণ কী
গত সপ্তাহে হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম এবং ফেসবুকসহ ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করার সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে এই বিক্ষোভগুলো শুরু হয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নেপালের রাজনৈতিক অভিজাতদের প্রতি তীব্র অসন্তোষ।
নিষেধাজ্ঞার আগের সপ্তাহগুলোতে রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে একটি ‘নেপো কিড’ প্রচার সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
এরই মধ্যে গত সোমবার তাড়াহুড়ো করে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পরও বিক্ষোভ ততক্ষণে অপ্রতিরোধ্য গতি অর্জন করে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রথম দিনই ১৯ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়।
সহিংসতা কীভাবে বৃদ্ধি পেল
পরদিন মঙ্গলবার আরও তিন জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলে এটি ক্ষোভ ও অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুই পুলিশ সদস্যও প্রাণ হারিয়েছেন।
এরপর থেকে বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল এবং কাঠমান্ডুতে শাসক জোটের অংশ নেপালি কংগ্রেস পার্টির সদর দপ্তর ও এর নেতা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় জনতা। শত শত বিক্ষোভকারী পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়, জানালা ভেঙে দেয় এবং দেয়ালে দুর্নীতিবিরোধী গ্রাফিতি স্প্রে করে।
সিংহ দরবার – একটি বৃহৎ কমপ্লেক্স, যেখানে সরকারি অফিস রয়েছে, সেখানেও হামলা চালানো হয়। সবশেষ হতকাল বুধবার সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করে, গুরুতর ক্ষতির কারণে বিচারাধীন মামলার সমস্ত শুনানি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
বিক্ষোভে আহতদের মধ্যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঝলনাথ খানালের স্ত্রী রবিলক্ষ্মী চিত্রকরও রয়েছেন। তিনি মঙ্গলবার কাঠমান্ডুতে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর গুরুতর দগ্ধ হন। কিছু সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, রবিলক্ষ্মী মারা গেছেন। তবে তার স্বামী বিবিসি নেপালিকে জানিয়েছেন, তার স্ত্রী রাজধানীর কীর্তিপুর বার্নস হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে গুরুতর অবস্থায় জীবিত রয়েছেন।
আগুন লাগার সময় তিনি বাড়ির ওপরের তলায় ছিলেন। পাশের একটি বাড়ি থেকে সিঁড়ি দিয়ে প্রবেশের সময় জরুরি পরিষেবাগুলো তাকে উদ্ধার করে।
স্থানীয় কর্মকর্তারা বিবিসি নেপালিকে জানিয়েছেন, মঙ্গলবারের বিশৃঙ্খলার সময় সারা দেশের কারাগার থেকে হাজার হাজার বন্দীও পালিয়ে গেছে।
রাতের দিকে পশ্চিম নেপালের বাঁকেতে একটি কিশোর সংশোধনাগার থেকে পালিয়ে আসা বন্দীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালালে পাঁচ তরুণ নিহত হয়। কারাগারের একজন পরিচালকের মতে, তাদের সকলের বয়স ১৮ বছরের কম।
এখন কি হবে
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ফলে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়েছে, কিন্তু কে তার স্থলাভিষিক্ত হবেন বা পরবর্তীতে কী হবে তা স্পষ্ট নয়। আপাতদৃষ্টিতে এখন কেউই দায়িত্বে নেই।
জেন-জি বিক্ষোভকারীরা তাদের বিবৃতিতে বলেছেন, ‘সামনের দিকে তাকিয়ে, আমরা বিশ্বাস করি নেপালের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে অবশ্যই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থেকে মুক্ত, সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে নির্বাচিত হতে হবে।
‘আমরা একটি স্বচ্ছ ও স্থিতিশীল সরকার দাবি করি, যা জনগণের স্বার্থে কাজ করবে, দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি বা রাজনৈতিক অভিজাতদের স্বার্থে নয়।’
কাঠমান্ডুর ৪০ বছর বয়সী সমাজকর্মী তারু কার্কি একই প্রতিধ্বনিতে বলেন, ‘গভীর উদ্বেগ বিরাজ করছে এবং নিরীহ তরুণরা মারা যাচ্ছে। দেশের এখন যা প্রয়োজন তা হলো, শান্তি এবং দুর্নীতির অবসান। যথেষ্ট হয়েছে।’
তথ্যসূত্র: বিবিসি