
রংপুর এলজিইডির সাধারণ ঠিকাদার থেকে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর উত্থান। সেখানে ছোটখাটো ঠিকাদারি কাজ করতেন। এরপর স্বাস্থ্য বিভাগে ঠিকাদারি শুরু করেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। গত দুই যুগ ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সকল কেনাকাটা, বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্য ছিল মূলত মিঠুর নিয়ন্ত্রণে। মিঠুর টাকা পকেটে যায়নি এমন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা খুবই কম। মিঠু অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন এবং অনেককে কোটিপতি বানিয়েছেন। মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিভাগীয় দপ্তর ও সিভিল সার্জন অফিসসহ স্বাস্থ্যের বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ অফিসে তার পছন্দের লোককে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হতো। সাধারণ কর্মচারী থেকে কর্মকর্তা পর্যন্ত প্রশাসনে তার নিয়োজিত লোক ছিল। মিঠুর দুর্নীতির সহযোগীরা এখনো ঘাপটি মেরে রয়েছে।
মিঠুর দুর্নীতির সহযোগী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেরানি আফজালের দুই শতাধিক কোটি টাকার সম্পদ দেশ-বিদেশে রয়েছে। কানাডাতে তার সম্পদ রয়েছে। সেখানে তার পরিবারের সদস্যরা বসবাস করছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক মালেকের রাজধানীতে গাড়ি বাড়িসহ কোটি কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। কেরানি আফজাল ও গাড়িচালক মালেক গ্রেপ্তার হওয়ার পর বের হয়ে আসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়সহ সমগ্র স্বাস্থ্য খাতের অনিয়মের নানা চিত্র। জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম বের হয়ে আসে।
বিগত সরকারের আমলে আফজাল, মালেকসহ স্বাস্থ্যের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বড় একটি গ্রুপ মিঠুর দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। মিঠুর আমেরিকা ও কানাডাসহ দেশ-বিদেশে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। বর্তমানে আলোচিত এই স্বাস্থ্য মাফিয়া মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর রাতে গুলশান এলাকার একটি বাসা থেকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল মিঠুকে গ্রেপ্তার করে। সে গ্রেপ্তার হওয়ার পর বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আতঙ্কে রয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া তার দুর্নীতির সহযোগী অনেকে অবসরে চলে গেছেন।
২০১০ সাল থেকে মিঠু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ একাধিক কর্মকর্তার সন্তান কিংবা পরিবারের সদস্যরা মিঠুর দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে অধিদপ্তরসহ উপজেলা পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগে মিঠুর নেটওয়ার্ক গড়ে উঠে। দুই যুগের অধিককাল যন্ত্রপাতি ও ওষুধসামগ্রী কেনাকাটার নামে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। নিয়োগ বাণিজ্যের নামে মিঠু চক্র শত শত কোটি টাকা কামিয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের কয়েক জন কর্মকর্তা জানান, মিঠু শীর্ষ কর্মকর্তার রুমে প্রবেশ করলে ঐ সময় কোনো কর্মকর্তা কিংবা কোনো দর্শনার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকত। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা ইত্তেফাককে জানান, মিঠু চক্রের কাছে পুরো স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়োগ, কেনাকাটা ও পদোন্নতি বাণিজ্য প্রায় দুই যুগ ধরে নিয়ন্ত্রণে ছিল। মিঠু ও তার সহযোগীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হলে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য থাকবে না।
জানা গেছে, মিঠুর সরবরাহকৃত কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অনেক যন্ত্রপাতি চালু করার কয়েক মাস পর বিকল হয়ে গেছে। মিঠুর সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতি নিম্নমানের ও ব্যবহারের অনুপযোগী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা সরকারকে লিখিতভাবে জানিয়ে ছিলেন যে স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটার অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতির মূল কারণ হচ্ছে, এ খাত মিঠু চক্রের দখলে রয়েছে। এই চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে প্রকাশিত বহুল আলোচিত পানামা পেপারসে বাংলাদেশের ঠিকাদার ব্যবসায়ী হিসেবে মিঠুর নাম উল্লেখ রয়েছে।