
‘সম্প্রতি আমার ব্রেকআপ হয়েছে। কাজে মনোযোগ দিতে পারছি না। সামান্য বিরতি দরকার। আজ বাসা থেকে কাজ করব।’ গুরগাঁওভিত্তিক জীবনসঙ্গী খোঁজার অ্যাপ ‘নট ডেটিং’-এর এক কর্মীর পাঠানো এই সংক্ষিপ্ত ই-মেইল এখন পুরো ভারতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ, করপোরেট ভাষার বদলে এতে ছিল একেবারেই অকপট মানবিক আবেদন।
আরও অবাক করার বিষয়—প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মুহূর্তের মধ্যেই ওই কর্মীর ছুটি মঞ্জুর করেন এবং সেই ই-মেইল অনলাইনে শেয়ার করে লেখেন,
“এটাই আমার দেখা সবচেয়ে সৎ ছুটির আবেদন।”
এরপরই পোস্টটি ভাইরাল হয় লিংকডইন, এক্স ও ইনস্টাগ্রামে। কেউ একে বলেছেন ‘সহানুভূতিশীল নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত’, আবার কেউ এটিকে ‘পেশাগত সীমারেখা ভাঙার ঝুঁকি’ বলে সমালোচনা করেছেন।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনাটি আসলে কর্মক্ষেত্রে নতুন প্রজন্ম—জেনারেশন জেড (Gen Z)—এর চিন্তাভাবনার প্রতিফলন।
বিশ্লেষকদের মতে, জেন-জি প্রজন্ম (১৯৯৭–২০১২ সালে জন্ম নেওয়া) বিশ্বাস করে—কর্মক্ষেত্রে মানবিক হওয়া দুর্বলতা নয়, বরং অপরিহার্য। কাজের দক্ষতার পাশাপাশি মানসিক স্থিতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাজ্যের লিগ্যাল অ্যান্ড জেনারেল গ্রুপ প্রোটেকশন–এর এক জরিপে দেখা গেছে, গত এক বছরে প্রতি তিনজন জেন-জি কর্মীর একজন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগেছেন—যা অন্য সব প্রজন্মের তুলনায় বেশি।
দীর্ঘদিন ধরে করপোরেট সংস্কৃতিতে ‘পেশাদারিত্ব’ মানে ছিল ব্যক্তিগত অনুভূতিকে আড়াল করা। কিন্তু কোভিড-পরবর্তী যুগে কাজ ও জীবনের সীমারেখা অনেকটাই মিশে গেছে। হাইব্রিড ওয়ার্ক, অনলাইন সংযোগ ও মানসিক চাপের কারণে অফিস এখন আর কেবল কাজের জায়গা নয়, অনেকের জন্য আবেগের জায়গাও হয়ে উঠেছে।
২০২৪ সালের ফিউচার ফোরাম জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৪২ শতাংশ কর্মী বর্তমানে বার্নআউট (Burnout)-এর শিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে ইতোমধ্যে ‘পেশাগত মানসিক অবস্থা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বার্নআউট বলতে বোঝায় দীর্ঘস্থায়ী ও অতিরিক্ত চাপ থেকে সৃষ্ট মানসিক, শারীরিক ও আবেগিক অবসন্নতা। এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্লান্তি, কাজ থেকে মানসিক দূরত্ব, উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং হতাশা।
ব্রেকআপের পর ছুটি কি যুক্তিযুক্ত?
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সম্পর্ক ভাঙা মানসিকভাবে অনেকটা শোকের মতো প্রভাব ফেলে। ঘুমের ব্যাঘাত, মনোযোগের ঘাটতি, উদ্যমহীনতা—সব মিলিয়ে কর্মক্ষমতা কমে যায়। বিশেষ করে যেসব কর্মী আগেই মানসিক চাপে ছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়।
তাই অল্প কিছুদিনের বিরতি অনেক সময় বার্নআউট প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে সব প্রতিষ্ঠানই এমন আবেগঘন ছুটি দিতে আগ্রহী নয়। অনেক এইচআর বিশেষজ্ঞের মতে, ব্যক্তিগত কারণকে ছুটির বৈধ অজুহাত হিসেবে স্বীকৃতি দিলে নীতিগত জটিলতা ও অপব্যবহার ঘটতে পারে।
অন্যদিকে, আধুনিক কর্মসংস্কৃতির সমর্থকেরা বলছেন—সহানুভূতি ও পেশাদারিত্ব পরস্পরের বিপরীত নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক।
মনোবিজ্ঞানীদের পরামর্শ—প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে কিছু বাস্তবসম্মত কাঠামো গ্রহণ করতে পারে, যেমন:
- 
মানসিক বা আবেগঘন কারণে ব্যক্তিগত ছুটির সুযোগ রাখা, 
- 
গোপনীয় মানসিক পরামর্শ সেবা (Employee Assistance Program), 
- 
ব্যবস্থাপকদের প্রশিক্ষণ যাতে তারা কর্মীর মানসিক সংকেত বুঝতে পারেন, 
- 
ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের পর ধাপে ধাপে কাজে ফেরার সুযোগ তৈরি করা। 
এতে একদিকে কর্মীর মর্যাদা রক্ষা পায়, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতাও অটুট থাকে।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সম্পর্ক ভাঙার পর মানসিক ভারসাম্য ধরে রাখার জন্য কর্মীদের উচিত—
- 
আবেগের বিষয়টি স্বীকার করা, 
- 
অতিরিক্ত কাজের চাপ না নেওয়া, 
- 
প্রয়োজন হলে বাসা থেকে কাজ বা অল্প ছুটি নেওয়া, 
- 
ঘুম, ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা, 
- 
বিশ্বাসযোগ্য সহকর্মী বা কাউন্সেলরের সঙ্গে কথা বলা, 
- 
পেশাদার আচরণ বজায় রাখা, এমনকি উৎপাদনশীলতা কমলেও খোলামেলা জানানো। 
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, জেন-জি প্রজন্মের কাছে ‘পেশাদারিত্ব’ মানে আবেগ লুকিয়ে রাখা নয়, বরং আবেগের মধ্য দিয়েই দৃঢ় হয়ে ওঠা। তাই ব্রেকআপের পর ছুটি চাওয়া দুর্বলতা নয়—এটি স্বচ্ছতা ও মানসিক পরিপক্বতার প্রকাশ।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া
 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
	