
সাম্প্রতিক বৃষ্টিপাতের ফলে অনেক সবজিখেত ডুবে গেছে এবং সবজির সরবরাহ কমে গেছে। সবজির দাম বেশি হওয়ায় ডিমের চাহিদা বেড়েছে, যার ফলে ডিমের দামও বেড়েছে। গত কয়েক মাস ধরে ডিমের দাম কম থাকায় কৃষকরা লোকসানের মুখে পড়েছেন এবং এখন ডিমের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা স্বস্তিবোধ করছেন।
‘ছয় মাস ধরে দাম কম থাকার পর ডিমের চাহিদা বেড়েছে’ বলেন—টাঙ্গাইলের সখিপুরের গোবিন্দপুরের জাহিদুল ইসলাম (৩৮)। তিনি ১৫ বছর ধরে লেয়ার খামারি। ১২ আগস্ট তিনি জানান, এখন খামারিরা প্রতি ডিম বিক্রি করে ৯.৫ টাকা পাচ্ছেন। অথচ প্রতি ডজন ডিম উৎপাদনে খামারিদের খরচ হয় ১০.২৫ থেকে ১০.৫০ টাকা (প্রায়)।
জাহিদুল জানান, ‘তার ৮,৫০০ লেয়ার মুরগি রয়েছে। এ খামার থেকে উৎপাদিত প্রতিটি ডিম যখন ৭ টাকা দরে বিক্রি করতে হয়েছে তখন ডিম প্রতি গড় ক্ষতি হয়েছে ২-২.৫ টাকা। টানা লোকসানের মধ্যেও খামার চালিয়ে রাখতে ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা ঋণ নিতে হয়েছে। বর্তমানে ডিমের দাম কেন বাড়ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি মাংস, মাছ এবং সবজির দাম বেড়েছে, তাই নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি পরিমাণে ডিম কিনছেন। এতে ডিমের দামও বেড়েছে।’
সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশে প্রতিদিন আনুমানিক ৪.৫ কোটি ডিম উৎপাদন হয়, অথচ চাহিদা ৫ কোটি ডিমের। তবে, দেশে মোট উৎপাদিত ডিমের সঠিক সংখ্যা বলা দুরূহ। কারণ গ্রামীণ পরিবারগুলোতে প্রচুর সংখ্যক ডিম পাড়ার মুরগি রয়েছে। তবে সংখ্যাটি অনিশ্চিত। তবে, যা সর্বজনস্বীকৃত তা হলো, সবজির দাম বৃদ্ধি পেলে ডিমের চাহিদা (এবং ডিমের দাম) সর্বদা বৃদ্ধি পায়।
পারিবারিক ব্যবসার অংশ হিসেবে মধুপুরের শৈলবাইত এলাকার মজনু মিয়া (৩৩) ৪ হাজার মুরগির খামার পরিচালনা করেন। তার মতে, গত কয়েক মাসে অনেক খামারি লোকসানে ডিম বিক্রি করে বড় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ খামার বন্ধ করে দেওয়ার কারণে ডিমের উৎপাদন ১৫-২০ শতাংশ কমে গেছে। ‘সাম্প্রতিক বৃষ্টিপাতের ফলে অনেক জায়গায় সবজি নষ্ট হয়েছে। ফলস্বরূপ, ডিমের চাহিদা বেড়েছে।’ তার মতে, বর্তমানে প্রতিটি ডিমের ফার্মগেট মূল্য ১১ টাকা না হলে প্রান্তিক খামারিরা এ ব্যবসায় টিকে থাকতে পারবেন না।
মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেন (২৪) বলেন, তার পরিবারের মালিকানাধীন লেয়ার মুরগির খামারটি লোকসানি প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। ‘দাম কিছুটা বেড়েছে এটা খামারিদের জন্য ভালো, তবে এই ধারা ২-৩ মাসের বেশি নাও চলতে পারে,’ তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।
সখিপুরের স্থানীয় মসজিদের ইমাম মাওলানা জাহিদুল ইসলাম (৩৮) নিজ এলাকার বিভিন্ন খামার থেকে ডিম সংগ্রহ করেন এবং গাজীপুর ও ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার ডিম সরবরাহ করেন। এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘সম্প্রতি ডিমের চাহিদা বেড়েছে। আমি ক্রেতাদের কাছ থেকে প্রতিটি ডিমের জন্য ১০ পয়সা পাই এবং দামের ওঠানামায় আমার ওপর কোনো প্রভাব নেই। স্থানীয়ভাবে খুচরা মূল্যে ডিম বিক্রি করে আমি লাভ করতে পারি।’ দাম বাড়াতে কোনো সিন্ডিকেট আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আজ পর্যন্ত কেউ কখনো আমাকে দাম বাড়াতে বা কমাতে বলেনি।’
ঘাটাইলের গনোগ্রামের ব্যবসায়ী রহিম উদ্দিন (৫৮) বলেন, গত শীত মৌসুমে বাজারে প্রচুর শাকসবজি থাকার সময় ডিমের দাম কমতে শুরু করে। ‘প্রতি ডিম সাত টাকায় কিনেও আমি পাইকারদের কাছে বেশি বিক্রি করতে পারিনি। কারণ চাহিদা কম ছিল।’ কোনো সিন্ডিকেটের দ্বারা দামের হেরফের হওয়ার প্রসঙ্গ তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন।
বাংলাদেশের ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমানের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বেশ কিছু সময় ধরে ডলারের উচ্চমূল্য, আমদানিকৃত খাদ্য উপকরণের বর্ধিত ব্যয় এবং অন্যান্য ব্যয়ের কারণে ডিমের বাজারে কোনো স্থিতিশীলতা ছিল না। উৎপাদকরা সরকারের নির্দেশনা মেনে নির্ধারিত মূল্যে ডিম বিক্রি করেছেন। কিন্তু ডিম বিক্রিতে সরকারের বেধে দেওয়া দর যখন কমে গেছে তখন আর খামারিদের লোকসান ঠেকাতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘ডিমের দাম কমে গেলে আমরা খামারিদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলতে শুনি না।’ এই অ্যাসোসিয়েশন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে এক চিঠি পাঠিয়ে এ খাতের ব্যবসা টেকসই করার স্বার্থে খামারিদের সর্বোচ্চ বিক্রয় মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের সঙ্গে ৩০ শতাংশ মুনাফা যোগ করার তাগিদ দিয়েছেন।