
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন রাজধানীর চানখাঁরপুলে গুলি করে হত্যা করা হয় ছয় জনকে। সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন দুজন সাক্ষী। জবানবন্দিতে তারা বলেন, পুলিশের গুলিতেই ছয় জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. গোলাম মুর্তজা মজুমদারের নের্তৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এ জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
এ সময় প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম, শহিদুল ইসলাম, বিএম সুলতান মাহমুদ, আব্দুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। গতকাল দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে ১৩ জনের সাক্ষ্য ও জেরা সমাপ্ত হলো এই মামলায়।
জবানবন্দিতে সাক্ষী মো. টিপু সুলতান বলেন, ‘আমি ঢাকার নিউ মার্কেটে কাপড়ের দোকানে চাকরি করি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন ছিল। আমার বাসা নাজিম উদ্দিন রোডে। গত বছরের ৫ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার দিকে লং মার্চ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে চানখাঁরপুল বোরহানউদ্দিন কলেজের সামনে অবস্থান নিই। ঐ সময় আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে আসিফ মোহাম্মদ সজীব ভূঁইয়াও অংশগ্রহণ করে। আমরা সামনের দিকে যেতে থাকলে বোরহানউদ্দিন কলেজের গেইটের সামনে পৌঁছালে পুলিশ চানখাঁরপুল মোড় থেকে আমাদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি করে। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। পরবর্তী সময় শুনতে পাই, আমার এলাকার বড় ভাই ইয়াকুব ভাই নাজিম উদ্দিন রোডে সোহাগ হোটেলের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমি সেখানে গিয়ে দেখি ইয়াকুব ভাইয়ের পেট দিয়ে গুলি লেগে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। তার ভুঁড়ি বের হয়ে যায়। জাহিদ নামের একজন তার টিশার্ট খুলে ইয়াকুবের গুলিবিদ্ধ ক্ষতস্থানে বেঁধে দেয়। তারপর জনৈক আন্দোলনকারী ইয়াকুবকে একটি অটোরিকশায় তুলে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘শুনেছি যে, সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আমরা বোরহানউদ্দিন কলেজের কাছাকাছি অবস্থান করতে থাকি। পুলিশ গুলি করতে করতে কলেজের গেইট পর্যন্ত চলে আসে। পুলিশ আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করলে সেই গুলিটি আমার পাশে থাকা আন্দোলনকারী ইসমামুলের পেটে লেগে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। ইসমামুলকে আমি অটোরিকশায় উঠিয়ে দিলে জনৈক আন্দোলনকারী তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তী সময় জানতে পারি যে, সে তিন দিন পরে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যায়। ঐ দিন চানখাঁরপুলে ছয় জন আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’
জবানবন্দিতে মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি নৌবাহিনীতে মালামাল সরবরাহকারী। চানখাঁরপুলে বসবাস করি। গত বছরের ৫ আগস্ট সকালে আমার ছেলে আমাকে না বলে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তখন খুব গোলাগুলি হচ্ছিল। আমি ছেলেকে খুঁজতে বের হয়ে নিমতলি যাই। ফোন করি। ছেলে বলে, আমি নিমতলির কাছাকাছি আছি। গোলাগুলির জন্য রাস্তা ক্রস করতে পারছি না। আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে আমি ও আমার ছেলে খলিফা পট্টি এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দিই। আমরা চানখাঁরপুলের দিকে এগোচ্ছিলাম। তখন পুলিশ গুলি করতে করতে আমাদের দিকে আসে। পুলিশের গুলিতে আমার সামনে থাকা জুনায়েদ নামে একজন আন্দোলনকারী মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। তিন/চার জন আন্দোলনকারী জুনায়েদকে রিকশায় তুলে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেদিন বিকালের দিকে জানতে পারি যে, জুনায়েদ মারা গেছে। সেদিন আড়াইটার দিকে জানতে পারি শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। সেদিন চানখাঁরপুল এলাকায় পাঁচ/ছয় জন আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। আমি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সবার বিচার চাই।’
জবানবন্দি শেষে আসামি পক্ষের কৌঁসুলিরা তাদের জেরা করেন। প্রসঙ্গত, চানখাঁরপুল মামলায় ডিএমপির কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট জনের বিচার চলছে ট্রাইব্যুনালে। আসামিদের মধ্যে চার জন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।