
২০২৫ সালের শেষ প্রান্তে প্রকাশিত গুগলের বার্ষিক প্রতিবেদন ‘ইয়ার ইন সার্চ ২০২৫’ বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত রূপান্তরের একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছে।
সার্চ ডাটার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছর বাংলাদেশিরা বিনোদন থেকে শুরু করে রাজনীতি, প্রযুক্তি ও জীবনধারার নানা বিষয় নিয়ে আগের চেয়ে বেশি কৌতূহলী ও তথ্যনির্ভর হয়ে উঠেছেন। এই প্রতিবেদনকে অনেকেই বাংলাদেশের বদলে যাওয়া মানসিকতার এক ধরনের ডিজিটাল দলিল হিসেবে দেখছেন।
গুগলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল দেশীয় সংস্কৃতি ও বিনোদন। হলিউডের তুলনায় স্থানীয় সিনেমা, নাটক ও ওটিটি কনটেন্ট বেশি অনুসন্ধান করা হয়েছে। ঢালিউডের জন্য এই বছরটি ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সময়, যার প্রভাব সরাসরি সার্চ ট্রেন্ডে পড়েছে।
ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের তালিকায় শীর্ষে ছিলেন ঢালিউড সুপারস্টার শাকিব খান। তার অভিনীত চলচ্চিত্র ‘বরবাদ’ ছিল বছরের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও খোঁজা সিনেমা। একই সঙ্গে আফরান নিশোর অ্যাকশনধর্মী সিনেমা ‘তাণ্ডব’ এবং গ্রামীণ জীবনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ‘জংলি’ দর্শকদের আগ্রহ ধরে রেখেছে। টেলিভিশন ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ তার জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছে, আর নতুন নাটক ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’ তরুণ দর্শকদের মধ্যে আলাদা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ২০২৫ সাল বাংলাদেশকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। গুগলের সার্চ ডাটা বলছে, দেশের মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর প্রায় ৯৬ শতাংশই দৈনন্দিন কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করেছেন। শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের সার্চ তালিকায় সবচেয়ে বেশি উঠে এসেছে ‘জেমিনি’ এবং ‘ডিপসিক’-এর মতো এআই টুলের নাম। এতে স্পষ্ট হয়েছে, প্রযুক্তি এখন আর সীমিত গোষ্ঠীর বিষয় নয়, বরং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
খেলাধুলার ক্ষেত্রে সার্চের প্রধান চালিকা শক্তি ছিল ক্রিকেট। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০২৫ এবং এশিয়া কাপ ঘিরে দেশের দর্শকদের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ চলাকালে ‘লাইভ স্কোর’ অনুসন্ধানে রেকর্ড তৈরি হয়। ঘরোয়া ক্রিকেটে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ বিপিএল বছরের একটি বড় অংশজুড়ে সার্চের শীর্ষে ছিল। পাশাপাশি ফুটবলে ফর্টিস এফসি ও বসুন্ধরা কিংসকে ঘিরেও উল্লেখযোগ্য অনুসন্ধান লক্ষ্য করা গেছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে বছরের শেষ ভাগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা সার্চ ডাটায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। ৩০ ডিসেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু গুগলে বিপুল পরিমাণ অনুসন্ধানের জন্ম দেয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এই ঘটনাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি যুগের সমাপ্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে, যার প্রতিফলন স্পষ্টভাবে দেখা গেছে সার্চ প্রবণতায়।
জীবনধারা ও ভোক্তা আচরণেও পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে। ২০২৫ সালে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত ৩০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বলে সার্চ ডাটা থেকে ধারণা পাওয়া যায়। ইলেকট্রনিক্স ও ফ্যাশন পণ্য ছিল সবচেয়ে বেশি অনুসন্ধান ও কেনাকাটার তালিকায়। খাদ্যাভ্যাসে জনপ্রিয় হয়েছে ‘হট হানি’, ‘মাচা’ এবং ‘মাশরুম কফি’, যা স্বাস্থ্য সচেতনতার নতুন প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়।
ভ্রমণ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট তথ্য খোঁজার প্রবণতাও ছিল উল্লেখযোগ্য। লন্ডন, টোকিও ও কুয়ালালামপুর ছিল বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বেশি অনুসন্ধান করা আন্তর্জাতিক গন্তব্য। একই সঙ্গে ‘আমার আইপি অ্যাড্রেস কী’ কিংবা ‘জার্মান স্টাডি ভিসার আবেদন পদ্ধতি’-এর মতো প্রশ্নে উচ্চ সার্চ ভলিউম প্রমাণ করে, তথ্যভিত্তিক ও প্রস্তুতিমূলক চিন্তাধারার দিকে মানুষ আরও বেশি ঝুঁকছে।
সার্বিকভাবে ‘ইয়ার ইন সার্চ ২০২৫’ দেখিয়ে দিয়েছে, ২০২৬ সালের পথে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ একদিকে নিজের সংস্কৃতি ও পরিচয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে, অন্যদিকে বৈশ্বিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রস্তুতিও নিচ্ছে। এই সার্চ ট্রেন্ডগুলো মূলত একটি পরিবর্তনশীল জাতির মানসিকতারই ডিজিটাল প্রতিফলন।
সূত্র: গুগল ‘ইয়ার ইন সার্চ ২০২৫’