
গণভোটের সময় এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে মতভেদ নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর দিকেই বল ঠেলে দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। নিজ উদ্যোগেই দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে সিদ্ধান্ত জানাতে বলা হয়েছিল। সোমবার উপদেষ্টা পরিষদের ‘জরুরি বৈঠক’ থেকে এই সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পর ইতিমধ্যে তিন দিন পার হয়েছে। তবে, দলগুলোর সমঝোতার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। বিএনপি বলয় এবং জামায়াতসহ দলটির মিত্র আটটি দল এখন পর্যন্ত নিজ অবস্থানে অনড়।
সমঝোতার লক্ষ্যে কার্যকর অগ্রগতি না থাকলেও নির্বাচনি কাঠামো, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের বিষয়ে একটি ‘সমঝোতামূলক রূপরেখা’ তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য বুধবার দুই সদস্যের কমিটি করেছে জামায়াত। দুই সদস্য হলেন জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। অন্যদিকে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে দল দুটির সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ নিয়েছে ছয়দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণ অধিকার পরিষদ এবং এবি পার্টিসহ ৯টি দল। এ বিষয়ে ৯ দলের শীর্ষ নেতারা বুধবার নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছেন।
জামায়াতের ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর পল্টন মোড়ে বিক্ষোভ মিছিল-পূর্ববর্তী সমাবেশে বলেছেন, ‘দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য জামায়াত একটি কমিটি করেছে। অন্য দলগুলোও যাতে আলোচনার জন্য কমিটি গঠন করে। অবিলম্বে আলোচনা শুরু হোক। সময়ক্ষেপণ করা যাবে না।’ ডা. তাহের এটাও বলেছেন, ‘আলোচনার জন্য আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) সকালে আমি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে কল করেও পাইনি। তাকে আবারও কল করা হবে। তাকে অনুরোধ করা হবে, বিএনপির পক্ষ থেকেও যাতে আলোচনায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত আসে।’
ডা. তাহেরের এই বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল টেলিফোনে ইত্তেফাককে বলেন, ‘কথাটি সত্য নয়, তার (ডা. তাহের) সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘দলগুলোর কোর্টে বল ঠেলে সরকার একটা চালাকি করেছে। এখন যদি আমাদেরই আলোচনা করতে হয়—তাহলে এক বছর ধরে আমরা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে কেন বসলাম, কথা বললাম!’
সমঝোতায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ গ্রহণকারী ৯টি দলের মধ্যে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ইতিমধ্যে জামায়াত নেতাদের টেলিফোনে কথা হয়েছে। তাদেরকে অনুরোধ করেছি গণভোটটা সংসদ নির্বাচনের সঙ্গেই হবে—এটা যেন তারা মেনে নেন। কিন্তু, জামায়াত নেতারা ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজেদের অবস্থানের পক্ষে নানা যুক্তি দেখিয়েছেন। আমরা বিএনপির সঙ্গেও কথা বলব। আমরা চাইছি, দুই পক্ষই কিছুটা ছাড় দিয়ে একটা সমঝোতায় আসুক। কিন্তু, মনে হচ্ছে কেউ ছাড় দিতে রাজি নয়। আর তারা যদি নিজেদের অবস্থানে অটল থাকেন সেক্ষেত্রে আমাদের ৯ দলের পক্ষ থেকে সরাসরি তাদের সঙ্গে বৈঠক করা সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই নয়।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল যশোরে সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য তরিকুল ইসলামের স্মরণসভায় বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে, এর আগে নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কাজ করছে। তারা ঐকমত্যের জন্য দলগুলোকে সাত দিন সময় দিয়েছেন। জুলাই সনদ ও গণভোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। রাজনৈতিক দল তো হাতের খেলনার মতো নয়। সংস্কার কমিশনের সব সভায় আমরা গিয়েছি। মতামত দিয়েছি। যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। যেগুলো হয়নি, সেগুলো পরবর্তী পার্লামেন্টে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু তা না করে তারা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কাজ করছেন। দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’
অন্যদিকে, সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজন করাসহ পাঁচ দফা দাবিতে গতকাল রাজধানীর পল্টন মোড়ে বিক্ষোভ মিছিল-পূর্ববর্তী সমাবেশে জামায়াতের ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘নির্বাচনের আগে গণভোট দিতে হবে। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরেও গণভোট করতে আইনি বাধা নেই। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করব।’
উপদেষ্টা পরিষদের সোমবারের জরুরি বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘সরকার বহু আলোচনা করেছে। সরকার আর কোনো আয়োজন করতে যাচ্ছে না। আমরা দলগুলোকে কোনো আলটিমেটাম দিইনি, আহ্বান জানিয়েছি। দলগুলো নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে, সম্ভব হলে এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। দিকনির্দেশনা পেলে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত সহজ হবে। আমরা অপেক্ষা করব। তারপর সরকার সরকারের মতো পদক্ষেপ নেবে।’
এই পরিস্থিতিতে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সংশ্লিষ্ট প্রায় সব দলই মনে করছে—উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, সরাসরি প্রধান উপদেষ্টা যেন উদ্যোগ নেন। জামায়াত বলেছে, প্রধান উপদেষ্টাকেই রেফারির ভূমিকা নিতে হবে। এনসিপিসহ অন্য দলগুলোও প্রায় অভিন্ন কথা বলেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের গতকালের বৈঠকেও দলগুলোকে সাতদিন সময় দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘আনঅফিশিয়ালি (অনানুষ্ঠানিক) কিছু তো ডিসকাশন হচ্ছে। সাতটা দিন তাদের জন্য বলা হয়েছে। এখন পলিটিক্যাল পার্টিগুলো যদি কোনো ডিসিশন (সিদ্ধান্ত) না নেন, তো আগেই আইন উপদেষ্টা বলেছিলেন যে সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই একটা ডিসিশন নেবে। আর কী ডিসিশন হবে, সেবিষয়েও এখন প্রস্তুতিমূলক অনেক মিটিং হচ্ছে। আমরা আশা করব, পলিটিক্যাল পার্টিগুলো নিজেরা নিজেরাই পুরো বিষয়গুলোতে একটা ডিসিশনে আসবে।’ প্রেস সচিব বলেন, নির্বাচনের যে স্টেজ (মঞ্চ) তৈরি হয়েছে, পুরো জাতি এখন নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে আছে।