
দুই দিনের সহিংস বিক্ষোভে অন্তত ১৯ শিক্ষার্থী ও তরুণ নিহত হওয়ার পর নেপাল বুধবার তুলনামূলক শান্ত ছিল। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করেছেন, মন্ত্রিসভা ভেঙে গেছে। সেনাবাহিনী মঙ্গলবার রাত থেকে নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেল তরুণ বিক্ষোভকারীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
বিক্ষোভকারীদের বিভিন্ন শাখার প্রতিনিধিরা মঙ্গলবার রাতে দীর্ঘ ভার্চুয়াল বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারে নেতৃত্ব দেবেন অরাজনৈতিক একজন ব্যক্তি। আলোচনায় সবচেয়ে এগিয়ে আছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। কাঠমান্ডুর তরুণ মেয়র বালেন্দ্র শাহও (বালেন) আলোচনায় ছিলেন। তবে প্রাধান্য পাচ্ছেন কার্কি।
কে এই সুশীলা কার্কি?
জন্ম ৭ জুন ১৯৫২ সালে, বিরাটনগরে তার জন্ম। ১৯৭৫ সালে বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ও ১৯৭৮ সালে ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত নেপালের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। ২০০৪ সালে সাম্ভব কানুন পুরস্কারসহ একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন কার্কি। তিনি নারী অধিকার ও মানবাধিকারভিত্তিক সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন দীর্ঘদিন। লেখক, আইনশিক্ষক ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে।
২০১৬ সালে ইতিহাস গড়ে নেপালের প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন সুশীলা কার্কি। তবে মাত্র এক বছরের মধ্যে তাকে সংসদে অভিশংসনের মুখোমুখি হতে হয়। অভিযোগ ছিল, তিনি সরকারের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে রায় দিয়েছেন। এর আগে তিনি পুলিশের মহাপরিদর্শক নিয়োগে জ্যেষ্ঠতাকে উপেক্ষা করা অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন।
অভিশংসনের প্রক্রিয়ায় তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থগিত হলেও প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন না পাওয়ায় উদ্যোগটি ভেস্তে যায়। ২০১৭ সালের জুনে তিনি অবসরে যান।
আরেক সম্ভাব্য মুখ বালান
৩৫ বছর বয়সী কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহও অন্তর্বর্তী সরকারের সম্ভাব্য প্রধান হিসেবে আলোচনায় আছেন। ১৯৯০ সালে কাঠমান্ডুতে জন্ম নেওয়া বালেন্দ্র শাহ পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ভারতের বিশ্বেশ্বরাইয়া টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করেন। রাজনীতিতে আসার আগে তিনি নেপালের আন্ডারগ্রাউন্ড হিপহপ জগতে সক্রিয় ছিলেন। তার গান ও লেখায় দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কণ্ঠ ছিল তীব্র।
২০২২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাঠমান্ডুর মেয়র নির্বাচনে জয়ী হন তিনি। ৬১ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে তিনি মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীদের পরাজিত করেন। ব্যক্তিজীবনে স্ত্রী সাবিনা কাফলের সঙ্গে বসবাস করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত সক্রিয় থেকে তিনি নাগরিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সরাসরি জনগণের সঙ্গে কথা বলেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে অনলাইনে ‘বালেন ফর পিএম’ দ্রুত ট্রেন্ডে উঠে আসে। এক ব্যবহারকারী এক্সে লিখেছেন, ‘বালেন দাই, এখনই নেতৃত্ব নিন।’
আরেকজন লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা আর নেপালের মধ্যে পার্থক্য হলো, আমাদের কাছে একজন সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী আছেন, যিনি কেবল দেশের জন্য কাজ করবেন, নিজের স্বার্থের জন্য নয়।’
কী অপেক্ষা করছে নেপালের সামনে
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনায় এখন মূল দায়িত্ব পড়ছে সুশীলা কার্কির ওপর। বিক্ষোভকারীরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, পুরোনো রাজনৈতিক দলের নেতাদের আর গ্রহণযোগ্যতা নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে সুশীলা কার্কির গ্রহণযোগ্যতা ও দুর্নীতিবিরোধী ভাবমূর্তি তরুণদের মধ্যে আস্থা জাগিয়েছে। এখন আলোচনার মধ্য দিয়ে কীভাবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়, সেটিই নজরে থাকবে।
অধ্যাপক বিপিন অধিকারীর মতে, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ থেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পথ খোলা রয়েছে। তবে এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর শুধু ক্ষমতা ভাগাভাগির বাইরে গিয়ে তরুণ প্রজন্মের দাবিগুলোকেও আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, রয়টার্স, ডয়চে ভেলে