
খেলার মাঠে ভারত-পাকিস্তান মানেই অন্য রকম উত্তেজনা। মাঠের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মাঠের বাইরে টানটান আবহ। এশিয়া কাপে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে টসের সময় কিংবা খেলা শেষে হাত মেলাতে দেখা যায়নি দুই দেশের ক্রিকেটারদের। সীমান্তের রাজনীতি মাঠে ছাপ ফেলেছিল আচরণে। এবার সুপার ফোরে আবার মুখোমুখি হচ্ছে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। আগামী ২১ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টায় আবারও মাঠে নামবে দল দুটি। প্রশ্ন উঠছে-এইবার কি বদলাবে দৃশ্যপট, ক্রিকেটাররা কি মেলাবেন হাত?
গ্রুপ পর্বের লড়াইয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব আবারও ক্রিকেটের বাইরের বিতর্কে রূপ নিয়েছে। মাঠের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যতটা উত্তেজনাপূর্ণ, মাঠের বাইরেও ততটাই রাজনৈতিক ও আবেগঘন আবহ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে টসের সময় দুই দলের অধিনায়কের হাত না মেলানো এবং ম্যাচ শেষে ভারতীয় ক্রিকেটারদের পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের সঙ্গে করমর্দন থেকে বিরত থাকার ঘটনাই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ভারতীয় শিবিরের যুক্তি, সীমান্তে চলমান উত্তেজনা ও রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে ক্রিকেটারদের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভারতীয় দলের অধিনায়ক প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ হলেও দেশের স্বার্থ, সরকারি অবস্থান এবং ক্রিকেট বোর্ডের নীতি তাদের জন্য অগ্রাধিকার পেয়েছে। ফলে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত না মেলানোর সিদ্ধান্ত কেবল খেলোয়াড়দের নয়, বরং সরকারের পরামর্শ ও বিসিসিআইয়ের নীতির সমন্বয়ে গৃহীত। ভারতের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বার্তাবাহীও বটে।
এমন পরিস্থিতি পাকিস্তান দল মেনে নিতে পারেনি। গেল ম্যাচে তাদের প্রতিক্রিয়া আসে পুরস্কার বিতরণী বর্জনের মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান সরাসরি ম্যাচ রেফারি অ্যান্ডি পাইক্রফটের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। তার দাবি, পাইক্রফটই নাকি দুই অধিনায়ককে টসে হাত মেলাতে নিষেধ করেছিলেন। এ অভিযোগের সূত্র ধরে পিসিবি আইসিসির কাছে রেফারিকে সরানোর জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন করে। তবে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি তা প্রত্যাখ্যান করে জানায়, পাইক্রফট কেবল এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের নির্দেশনা অনুসরণ করেছেন।
এদিকে, পাকিস্তানের অভিযোগে আরও নতুন মাত্রা যোগ হয় যখন তারা পাইক্রফটের ‘ক্ষমা চাওয়ার ভিডিও’ প্রকাশ করে। ভিডিওতে পাকিস্তানের অধিনায়ক, টিম ম্যানেজার ও কোচকে বসে থাকতে দেখা যায় এবং সেখানে পাইক্রফটের সঙ্গে কথোপকথনের ইঙ্গিত মেলে। কিন্তু ভিডিওতে কোনো শব্দ না থাকায় সেই আলোচনার প্রকৃত বিষয়বস্তু স্পষ্ট হয়নি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো দাবি করে, পাইক্রফট কোনো ভুল স্বীকার করেননি কিংবা ক্ষমা চাননি। তাদের মতে, ভিডিওটি আসলে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্যই প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে ঘটনাটি আরও জটিল রূপ নেয়।
অন্যদিকে, এই অস্থিরতার কারণে দুবাইয়ে পাকিস্তানের পরবর্তী ম্যাচ নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ে টিম হোটেল ছাড়তে দেরি করায় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে, হয়তো পাকিস্তান এশিয়া কাপ বর্জনের ঘোষণা দিতে পারে। শেষ মুহূর্তে অবশ্য তারা মাঠে নেমেছে, তবে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ নিয়ে এক ধরনের চাপ ও অস্বস্তি যে থেকেই গেছে, তা স্পষ্ট।
এই পুরো প্রেক্ষাপটে কয়েকটি বিষয় ওঠে এসেছে। প্রথমত, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই এখন কেবল ক্রিকেটীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতীকও বটে। করমর্দনের মতো ক্ষুদ্র একটি আচরণও কূটনৈতিক টানাপোড়েনের প্রতিফলন হয়ে উঠছে। দ্বিতীয়ত, ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও টুর্নামেন্ট আয়োজকরা এমন সংবেদনশীল ইস্যুতে কতটা নিরপেক্ষ থাকতে পারছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পিসিবি মনে করছে, ম্যাচ রেফারি তাদের প্রতি অন্যায্য আচরণ করেছেন। বিপরীতে আইসিসি বলছে, সব কিছু নিয়ম অনুযায়ীই হয়েছে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এই বিতর্কে ক্রিকেট কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? খেলোয়াড়দের জন্য খেলাধুলা হওয়া উচিত সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক সম্মানের ক্ষেত্র। কিন্তু সীমান্ত উত্তেজনা, বোর্ডগুলোর দ্বন্দ্ব আর রাজনৈতিক প্রভাব সেই মূল ভাবনাটিকেই আড়াল করছে। মাঠের ভেতরে প্রতিযোগিতা চললেও মাঠের বাইরে বিশ্বাসের সংকট দিন দিন গভীর হচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, এশিয়া কাপে একটি ম্যাচের পরিপ্রেক্ষিতেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের জটিলতা নতুন করে প্রকাশিত হলো। পাইক্রফটের নাম ঘিরে বিতর্ক, ভিডিও প্রকাশ, সংবাদমাধ্যমের পাল্টাপাল্টি খবর- সবকিছুই প্রমাণ করছে ক্রিকেট এখানে আর শুধুই খেলা নয়। এই ঘটনার পর সামনের ম্যাচ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে- এই অধ্যায় আসলেই এখানেই শেষ হবে, নাকি ভবিষ্যতে আরও বড় কোনো সংকটের সূচনা ঘটাবে?
আগামী রোববার ম্যাচ রেফারি হিসেবে হয়তো পাইক্রফটকে দেখা যাবে না, তার জায়গায় থাকতে পারেন রিচি রিচার্ডসন। তবু কি দুই দেশের ক্রিকেটাররা হাত মেলাবেন? সব কিছু যেভাবে চলছে তাতে না মেলানোর সম্ভাবনাই বেশি। তবে পরিস্থিতি তাদের কোন পথে নিয়ে যায়, সেটিই এখন সময়ের অপেক্ষা।