
২০২৬ সাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য রোমাঞ্চকর হলেও স্বস্তির নাও হতে পারে। বড় প্রযুক্তি কোম্পানির ভেতরের চাপ, বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাব, কর্মক্ষেত্রে নজরদারির বিস্তার আর রোবটের বাস্তব দুনিয়ায় প্রবেশ—সব মিলিয়ে সামনে অপেক্ষা করছে বেশ কয়েকটি অস্বস্তিকর বাস্তবতা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি সাময়িকী ওয়্যার্ড-এ প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে আগামী বছরের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঘিরে ছয়টি ‘ভয়ংকর’ পূর্বাভাস তুলে ধরা হয়েছে।
এআই খাতে বড় ছাঁটাইয়ের শঙ্কা
চলতি মাসে ওপেনএআই প্রতিদ্বন্দ্বিতা জোরদার করতে ‘কোড রেড’ ঘোষণা করেছে। এতে অনেকের মনে পড়ে গেছে তিন বছর আগের ঘটনা, যখন ওপেনএআইকে টেক্কা দিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে গুগল ইতিহাসের প্রথম বড় ছাঁটাইয়ে যায়। সে সময় প্রতিষ্ঠানটি একে ভবিষ্যতের জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিল।
এখন প্রশ্ন উঠছে—২০২৬ সালের শুরুতেই কি ওপেনএআইও একই পথে হাঁটবে? এই আশঙ্কা থেকেই বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে ছাঁটাই নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
ডেটা সেন্টার নিয়ে গুজবের বিস্তার
বিশ্বজুড়ে ডেটা সেন্টার নির্মাণ ঘিরে স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধিতা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক নাগরিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ওয়্যার্ড-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো আগে থেকেই অনলাইনে ভুয়া তথ্য ছড়াতে পারদর্শী।
র্যান্ড করপোরেশনের গবেষক অস্টিন ওয়াং বলেন, আপাতত এসব অ্যান্টি ডেটা সেন্টার আন্দোলনের পেছনে প্রকৃত মার্কিন নাগরিকরাই রয়েছেন। তবে আন্দোলন জোরালো হলে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপের ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এআই দিয়ে ছবি ও ভিডিও তৈরি সহজ হওয়ায় গুজব ছড়ানোর গতি আরও বাড়তে পারে।
প্রযুক্তি মেলায় রোবটের দাপট
২০২৬ সালে সিইএস থেকে শুরু করে বড় প্রযুক্তি সম্মেলনগুলোতে এআইচালিত রোবটই থাকবে আলোচনার কেন্দ্রে। গুগলসহ শীর্ষ কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে রোবটকে ঘরের কাজ শেখানোর চেষ্টা করছে।
সম্প্রতি গুগল একটি ভিডিওতে দেখিয়েছে, রোবট মুখে বলা নির্দেশ শুনে আবর্জনা আলাদা করছে। আগামী দিনে এমন রোবটও দেখা যেতে পারে, যারা আগে না দেখা চুলায় খাবার ঢুকিয়ে দেবে বা ভিড় ঠাসা ফ্রিজ থেকে নির্দিষ্ট পানীয় বের করে আনবে।
জেনারেল মোটর্সের সাবেক প্রধান এআই কর্মকর্তা বারাক তুরোভস্কির ভাষায়, “বড় ভাষা মডেলের পরের সীমান্ত হলো বাস্তব দুনিয়া।”
কর্মীদের নজরদারি থেকে এআই প্রশিক্ষণ
অনেক প্রতিষ্ঠান আগেই কর্মীদের কম্পিউটারে নজরদারি সফটওয়্যার বসিয়েছে। ২০২৬ সালে এই নজরদারি আরও গভীর হতে পারে। কর্মীদের ক্লিক, স্ক্রল আর টাইপিং রেকর্ড করে এআই এজেন্টকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনাও আলোচনায় এসেছে।
কাস্টমার সাপোর্টের মতো কাজে এমন এআই এজেন্ট ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। কর্মী অধিকারকর্মী উইলনেইডা নেগ্রনের মতে, এতে চাকরি হারানোর ভয় যেমন বাড়বে, তেমনি ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঝুঁকিও তৈরি হবে।
সব সময় শোনা ডিভাইস, সব সময় ঝুঁকি
সব সময় মাইক খোলা রাখা গ্যাজেট জনপ্রিয় না হলেও ভিডিও কল শুনে নোট বানানো এআই টুল দ্রুত ছড়িয়েছে। গ্রানোলা নামের একটি টুল স্থায়ীভাবে অডিও সংরক্ষণ না করেই মিটিংয়ের সারাংশ তৈরি করতে পারে।
তবে সমস্যা হলো, অংশগ্রহণকারীদের না জানিয়ে এ ধরনের টুল কাজ করতে পারে। এআই আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, তৃতীয় পক্ষের ওপর এআইয়ের প্রভাব নিয়ে আইনি প্রশ্ন আরও তীব্র হবে। ওয়্যার্ড-এর পূর্বাভাস, ২০২৬ সালে এ সংক্রান্ত বড় কোনো মামলা বা ডেটা ফাঁসের ঘটনাও সামনে আসতে পারে।
রোবট্যাক্সি বাড়বে, দুর্ঘটনায় দায়ী থাকবে মানুষ
২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রোবট্যাক্সি সেবা দ্রুত সম্প্রসারিত হতে পারে। ওয়েইমো সপ্তাহে ১০ লাখের বেশি রাইড দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে এবং সেবা ২৫টি শহরে ছড়ানোর পরিকল্পনা করছে। টেসলা ও অ্যামাজনের মালিকানাধীন জুক্সও একই পথে হাঁটছে।
অনেকে আশঙ্কা করছেন, এতে বড় দুর্ঘটনা ঘটবে। তবে সরকারি তথ্য বলছে, অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মানুষই দায়ী। রোবট্যাক্সির সংখ্যা এখনও সীমিত এবং এগুলো ঝুঁকি এড়াতে প্রোগ্রাম করা। ফলে ভয়াবহ দুর্ঘটনার চেয়ে মানুষের ভুলেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
সব মিলিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়—২০২৬ সালে এআই কি জীবন সহজ করবে, নাকি নতুন ভয় যোগ করবে? সময়ই দেবে তার উত্তর। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত, সামনে বছরটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঘিরে বড় বিতর্ক ও সিদ্ধান্তের বছর হতে যাচ্ছে।