
গত দুই বছর ধরে গাজায় চলমান দখলদার ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে এবার ইসরায়েলি চলচ্চিত্রশিল্পকে বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্বের নামকরা বহু চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত এক অঙ্গীকারপত্রে ১৮০০-এর বেশি অস্কারজয়ী অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে খ্যাতিমান পরিচালক ও প্রযোজকরা তাতে স্বাক্ষর করেন।
তাদের দাবি-গণহত্যা ও বর্ণবাদের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর কোনো সহযোগিতা নয়।
সম্প্রতি ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক খোলা চিঠিতে তারা এ ঘোষণা দেন।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেই খোলা চিঠিতে বলা হয়, ‘আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, ইসরায়েলি সরকার-সমর্থিত বা গণহত্যা ও বর্ণবাদের সঙ্গে জড়িত কোনো চলচ্চিত্র উৎসব, সিনেমা হল, সম্প্রচারমাধ্যম বা প্রযোজনা সংস্থার সাথে কাজ করব না, সেখানে আমাদের চলচ্চিত্র প্রদর্শন করব না বা কোনো ধরনের সহযোগিতায় যুক্ত হবো না।’
চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, এ বয়কটের লক্ষ্য কোনো ব্যক্তিগত শিল্পী নন, বরং যেসব প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে জড়িত বা তাদের কর্মকাণ্ডকে ‘সাদা ধোঁয়া’ দেয়, কেবল সেসব প্রতিষ্ঠান।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শিল্পীদের এই সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ এমন এক সময় এলো, যখন গাজায় যুদ্ধের কারণে কয়েক লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, হাজারো শিশু অপুষ্টি ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে। বহু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ইতোমধ্যেই ইসরায়েলের পদক্ষেপকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতও একই মত দিয়েছে।
এর আগে ইতালির চলচ্চিত্রকর্মীরা ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল বয়কটের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২০০ জনের বেশি ব্রিটিশ ও আইরিশ লেখকও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একই দাবি জানিয়েছেন।
এর ফলে জেরুজালেম ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, হাইফা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ডোকাভিভ, তেল আবিব ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং টিএলভি ফেস্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ আসরে থাকবে না তাদের সিনেমা বা উপস্থিতি।
‘ফিল্ম ওয়ার্কার্স ফর প্যালেস্টাইন’-এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে- ‘এমন এক সংকটময় মুহূর্তে যখন বিশ্বের বহু সরকার গণহত্যাকে সমর্থন দিয়ে চলেছে, তখন এই ভয়াবহতাকে রুখে দিতে আমাদের সবকিছু করতে হবে। ইসরায়েলি সিনেমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, পরিবেশক বা বিক্রয় এজেন্ট- কেউই কখনো ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে দাঁড়ায়নি।’
বয়কটের ডাক দেওয়া তারকাদের তালিকায় রয়েছেন- মার্কিন তারকা এমা স্টোন, মার্ক রাফালো, আয়ো এডেবিরি, সিনথিয়া নিকসন, ব্রিটিশ অভিনেত্রী অলিভিয়া কোলম্যান, রিজ আহমেদ, টিল্ডা সুইনটন, জো অ্যালউইন, স্প্যানিশ অভিনেতা জেভিয়ার বারডেম। এ ছাড়া আরো রয়েছেন লিলি গ্ল্যাডস্টোন, হান্না আইনবাইন্ডার, পিটার সারসগার্ড, আইমি লু উড, পাপা এসিডু, গ্যয়েল গার্সিয়া বার্নাল, মেলিসা বারেরা, জশ ও’কনর প্রমুখ।
নির্মাতাদের তালিকায় রয়েছেন ইয়র্গোস ল্যান্থিমোস, আভা ডুভার্নে, অ্যাডাম ম্যাককে, বুটস রিলে, এমা সেলিগম্যান, জোশুয়া ওপেনহাইমার, গায়েল গার্সিয়া বারনাল, কেন লোচ, মাইক লেই প্রমুখ।
এর আগে গত মাসে ইতালীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একটি দল, ভেনিস ফর প্যালেস্টাইন, শহরটির চলচ্চিত্র উৎসবে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, একটি চিঠিতে অস্কার বিজয়ী পরিচালক গুইলারমো ডেল টোরোসহ ২০০০ জনের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে।
প্রায় ২০০ ব্রিটিশ এবং আইরিশ লেখক ইসরায়েলকে ‘তাৎক্ষণিক এবং সম্পূর্ণ’ বয়কটের আহ্বান জানান। তাদের ভাষ্যে, ‘এই বয়কট ততক্ষণ চলবে যতক্ষণ না পর্যন্ত গাজার জনগণকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানীয় জল, খাদ্য এবং চিকিৎসা সরবরাহ করা হয় এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গাজার জনগণের জন্য অন্য সব ধরনের ত্রাণ এবং প্রয়োজনীয়তা পুনরুদ্ধার করা হয়।’
সে সময় লেখকরা আরো বলেছিলেন, ‘আমরা সব জিম্মি এবং সব পক্ষের অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই বন্দি ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করছি। আমরা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বসতি স্থাপনকারী সহিংসতা বন্ধ করার দাবি করছি। আমরা হামাস এবং ইসরায়েলের দ্বারা অবিলম্বে এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং সহিংসতা বন্ধের দাবি করছি।’
এদিকে সদ্যই ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে ডকুমেন্টারি ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজব’, যেখানে গাজায় নিহত পাঁচ বছরের এক শিশুর করুণ গল্প উঠে আসে। চলচ্চিত্রটি রেকর্ড সময় ধরে স্ট্যান্ডিং অভেশন পেয়েছে। এর নির্বাহী প্রযোজক ছিলেন হলিউড তারকা ব্র্যাড পিট ও জোয়াকিন ফিনিক্স। বলা বাহুল্য, বিশ্বজুড়ে গাজার ধ্বংসস্তূপ ও ক্ষুধার্ত শিশুদের ছবি যত ছড়িয়ে পড়ছে, ততই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শিল্পীদের সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ তীব্র হচ্ছে।