
এশিয়ান আরচারিতে বাংলাদেশের আরচাররা একে একে ঝরে পড়ছেন। এদের মধ্যে এখনো আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন কুলসুম আক্তার মনি। ব্যক্তিগত ৫০ মিটার ইভেন্টে মনি এখনো অবস্থান ধরে রেখেছেন। কম্পাউন্ড বিভাগের এককে সেমিফাইনালে উঠেছেন মনি। পদক জয় করতে হলে আগামীকাল সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ ভারতকে হারাতে হবে। ভারতের প্রদীপ প্রিথিকারের বিপক্ষে লড়াই করতে হবে। কুলসুম আক্তার মনি দেশের উঠতি আরচার। বিকেএসপি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সাগর আলিফ, বন্যা, পুষ্পিতারা যখন ভালো কোনো খবর দিতে পারছিলেন না, তখন হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিলেন মনি।
গতকাল কোয়ার্টার ফাইনালে কুলসুম আক্তার মনি হারিয়ে দিলেন কাজাখাস্তানের ইউনুসোভাকে। ব্যবধান ছিল ১৪৬-১৪৪ পয়েন্ট। পরশু বিকালে টিম ইভেন্টে ইরানের কাছে হেরেছিল বাংলাদেশ। ইরানের দলে ছিলেন ফাতিমা বাঘেরি। সেই ফাতিমাকে হারিয়েছেন বাংলাদেশের কুলসুম আক্তার মনি। এরপর হারিয়েছেন ভারতের দ্বিপশিখাকে। এভাবেই একটা একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে ওপরের ওঠার সিঁড়িতে পা ফেলেছেন বাংলাদেশের আরচার, ঠাকুরগাঁওয়ের দরিদ্রঘরের সন্তান কুলসুম আক্তার মনি।
গতকাল সকালের সেশন শেষ করে মনি যেন সবার কাছে আদরণীয় হয়ে উঠলেন। পারফরম্যান্স না থাকায় অন্যরা যেখানে ছিটকে যাচ্ছেন, সেখানে আলোচনায় না থাকা মনি হয়ে গেলেন অন্য আরচারদের চোখেরমনি। তার কথা খুব স্পষ্ট। বুকে সাহস আছে। প্রচার চান না। কথা বেশি বলতেও চান না। ‘আমি এত বেশি হাইলাইট হতে চাই না। সোস্যাল মিডিয়া আমার একদমই পছন্দ না। আমি চাই না পৃথিবী আমাকে জানুক। হ্যাঁ জানুক, আমার যোগ্যতা দিয়ে জানুক। নিজের ইচ্ছায় না। আরচারিতে আমি কত ভালো স্কোর করতে পারলাম সেটি জানুক। অন্য কিছু নয়।’
কুলসুম আক্তার মনি, একেবারে দরিদ্র ঘরের সন্তান। বাবা গ্রামে পান দোকান করেন। এখন অসুস্থ হওয়ায় মা গিয়ে দোকানে বসেন। তিন ভাই বোনের সংসারে মনি এখন সবার চোখের আলো। সংসারের ভারও তার ওপর আছে। মনি যখন টার্গেট বোর্ডে নিশানা তাক করেন তার পৃথিবীটা অন্যকরম হয়ে যায়। অনেক স্বপ্ন ঘুরে বেড়ায় তার জগতে। খেলাটা ভালো করে খেলতে হবে। গ্রামে যখন ছিলেন তখন খেলার প্রতি অনেক ঝোঁক ছিল তার। ‘স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষকের মাধ্যমে খেলায় পা রাখি। আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ক্রীড়া শিক্ষক। দিনাজপুর বিকেএসপিতে ট্রায়াল দিই আরচারিতে।’ আরচারিতে পারফরম্যান্স এতই ভালো হলো, বিকেএসপিও মনিকে সুযোগ দিল, ভর্তি করে নিল। তার প্রতিভার আগুন ছড়িয়ে দিতেই বিকেএসপির প্রশিক্ষণ কাজে লাগল, জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে গেলেন মনি। ‘আমার ক্রীড়া শিক্ষক আমাকে বলছিলেন তুমি আরচারি করো। এটা অলিম্পিক খেলা, আন্তর্জাতিক পদক পাওয়ার চান্স আছে সত্যিকার অর্থে এর আগে আরচারি কি আমি চিনতাম না। আরচারি চিনেছি বিকেএসপিতে এসে-বললেন মনি।
মনি যখন আরচারি খেলায় প্রবেশ করেন তখন দেশের মেয়েরা ফুটবলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু মনি ধরে নিচ্ছে আরচারিটা খেললে আমাকে পোশাক নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তখনই আরো তির-ধনুকটা আরো শক্ত হাতে ধরলেন মনি। প্রথম বার আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলেছেন বাহারাইনে, সেটি ছিল স্কুল গেম। সিংগাপুরে এশিয়া কাপ, এরপর ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছেন তিনি। বিমানে উঠলে ওপর থেকে নিচে তাকিয়ে দেশটাকে দেখেন। নিজের দেশকে দেখতে ভালো লাগে কুলসুম আক্তার মনির। বিমানে বসে চোখে আলপনা আঁকেন মনি, দেশকে কিছু দেওয়ার স্বপ্ন আঁকেন। গায়ের জার্সিতে দেশের পতাকা দেখিয়ে মনি বলেন, ‘এই লাল-সবুজের জন্যই আমার লড়াই। আমার এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন।’