
রোগীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের রেজিস্ট্যান্স বেড়ে যাওয়ায় দেশের স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের রেজিস্ট্যান্স বেড়ে যাওয়াকে অ্যান্টিমাইক্রোরিয়াল রেজিস্টান্স হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ।
অতি সম্প্রতি গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুসাররাত সুলতানা সুমি এক গর্ভবর্তীর ইনফেকশনের জন্য ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছিলেন। কিন্তু তার ইনফেকশন ভালো হয়নি। চিকিত্সক ঐ অ্যান্টিবোয়েটিক ওষুধ পরীক্ষা করে দেখেন ওষুধটি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্ড। অর্থাত্ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধটির ইনফেকশন রোধ করার ক্ষমতা নেই। এ বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের মতে, অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে জীবাণু ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষম হয়ে উঠে, এর ফলে সাধারণ সংক্রামণও মৃত্যুর কারণ হতে পারে বলে জানান তিনি। ঐ গভবর্তী নারীকে তিনি অ্যান্টিবায়োটিক ক্যাপসুলের পরিবর্তে ইনজেকশন নেওয়ার ব্যবস্থাপত্র দেন।
বিশেষজ্ঞরা এই প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার কিংবা অপ্রয়োজনীয় ও নিয়মবর্হিভূতভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। তারা এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেন এবং অনুসন্ধানে অ্যান্টিবায়োটিক যত্রতত্র অপ্রয়োজনীয় চিকিত্সকদের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া মুড়ি মুড়কির মত বিক্রি ও ব্যবহারে ভয়ংকর তথ্য বরে হয়ে আসে। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা এ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য জানান।
সম্প্রতি আইসিডিডিআরবি ও এফএফসিজিবি যৌথভাবে দেশের ৮টি বিভাগীয় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিন হাজার তিন শ রোগীর অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কে জরিপ চালায়। বিশেষজ্ঞ টিম কর্তৃক পরিচালিত জরিপে অ্যান্টিবায়োটিকের ভয়াবহ অপব্যবহার, চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক রোগীর কাছে বিক্রি ও অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ব্যবহার করার তথ্য প্রমাণ পেয়েছেন। আরো দেখা গেছে, ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ সমাপ্তি করেননি বেশিরভাগ রোগী। ব্যবস্থাপত্রে ৫-১০ দিন অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও। অনেক রোগী ২ থেকে তিন দিন কিংবা ২ থেকে তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পর সুস্থ বোধ করলে ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী বাকি ওষুধ খান না বলে জরিপে উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞ টিম।
অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন ছাড়াও অনেক রোগী নিজেরা অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ টিমকে জানিয়েছেন অনেক রোগী। বিশেষজ্ঞ দলের মতে, অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত ব্যবহারে জীবাণু যখন ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষম হয়ে উঠে, তখন সাধারণত সংক্রামণও মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এই উদ্বেগজনক বাস্তবতাই উঠে এসেছে চলতি সালের প্রথম প্রান্তিকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ এএমআর নিউজ লেটারে।
ঢাকা বিভাগের একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরিপে উল্লেখ করা হয়, শিশু ও গাইনি বিভাগে রোগীদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের হার সর্বোচ্চ। শিশু বিভাগে ৮৯ ভাগ ও গাইনি বিভাগের রোগীকে ৮৬ ভাগ রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।
রংপুর বিভাগে একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানীয় জীবাণু প্রতিরোধ সংক্রান্ত তথ্য (অ্যান্টিবায়োগ্রাম) ব্যবহার না করে অনুমান নির্ভর ওষুধ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। এখনও সেখানে ব্যাপকভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ চলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুল ওষুধ প্রয়োগ হচ্ছে।
খুলনা বিভাগে একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সকদের মধ্যে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল স্ট্যুয়ার্ডশিপ (এএমএস) গাইড লাইন বিষয়ে স্পষ্ট ধারণার অভাব দেখতে পান বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা। যা সঠিক ব্যবস্থাপনার পথে অন্তরায়।
ময়মনসিংহ বিভাগের একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যাপক অনিয়ম চিত্রের কথা উল্লেখ রয়েছে জরিপে।
চট্টগ্রাম বিভাগের একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাপক ব্যবহারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন মানা হয়নি। এ বিভাগে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাপক ব্যবহার করায় জীবাণুদের প্রথাগত প্রতিরোধক্ষম হয়ে ওঠার তথ্য প্রমাণ পেয়েছেন জরিপ দল। শুধু এ বিভাগে নয়, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন কোথাও মানা হয়নি বলে জরিপ দলের একজন সদস্য জানিয়েছেন। তার মতে, ব্যবহূত ওষুধের অধিকাংশই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় শ্রেণি বিন্যাস পর্যবেক্ষণ ক্যাগারির অন্তর্ভুক্ত।
রাজশাহী বিভাগের একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তৃতীয় প্রজেন্মর চ্যাপালোস্পিরিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হার সব চেয়ে বেশি। যা চিকিত্সা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়াও সিলেট ও বরিশাল বিভাগের একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জরিপ দলের বিশেষজ্ঞ সদস্যরা স্বচক্ষে দেখেছেন সেখানে ওষুধ ব্যবহারে গাইড লাইন তো মানা হয়নি এবং অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ স্বচক্ষে দেখেন।
আন্তর্জাতিক উদারাময় কেন্দ্রে (আইসিডিডিআরবি) প্রোগ্রাম ফর ইর্মাজিক ইনফেকশন্স বিভাগের বিজ্ঞানি ডা. ফাহমিদা চৌধুরী বলেন, ‘জীবন রক্ষা করার ওষুধের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক অন্যতম। এ ওষুধে রেজিস্ট্যান্স একটি বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা। সাধারণ সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। পরবর্তী চিকিত্সাও কঠিন হয়ে পড়বে।’ চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া যত্রতত্র প্রযোগ অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি ও প্রয়োগ নিষিদ্ধ করা উচিত। এ বিষয় সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (এডুকেশন) অধ্যাপক ডা. সুমন নাজমুল বলেন, ‘রোগীর জীবন রক্ষায় অ্যান্টিবায়োটিক একটি সর্বশেষ ওষুধ। বিদ্যমান আইন রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। অপব্যবহার ও চিকিত্সকদের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি। এ ছাড়া বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইনের বাইরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে রোগীর ব্যাপক হারে মৃত্যু হতে পারে বলে তিনি সর্তক করেছেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল আলম বলেন, ‘রোগীদের জীবন রক্ষার্থে চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইনের বাইরে গিয়ে এ ওষুধ প্রয়োগ করলে রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি থাকবে বলে তিনি জানান।
অ্যানেশথিওলজিস্ট অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, ‘ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করতে হয় অনেক। সেই জীবন রক্ষাকারী ওষুধ যদি রেজিস্ট্যান্স হয় তাহলে রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম।’ এটিকে আইসিইউতে মৃত্যুর হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিন।