
‘সাত দিনের মধ্যে ডায়াবেটিস, ক্যানসার, যৌন দুর্বলতা ও জটিল রোগ সম্পূর্ণ নিরাময়’—এমন অবাস্তব ও আজগুবি গ্যারান্টি দিয়ে ইউটিউব, ফেসবুকসহ অনলাইন প্ল্যাটফরমে প্রকাশ্যে ভেজাল ও নকল ওষুধ বিক্রি চলছে। চিকিত্সা বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক এসব অপপ্রচারে আকৃষ্ট হয়ে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণির মানুষ জীবনঝুঁকিতে পড়ছেন বলে সতর্ক করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা।
বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, প্রশাসনের দুর্বল নজরদারি এবং এক শ্রেণির দায়িত্বশীল কর্মকর্তার অনিয়ম ও উেকাচ গ্রহণের সুযোগে এই প্রতারণামূলক ওষুধ বাণিজ্য দীর্ঘদিন ধরে নির্বিঘ্নে চলছে। অথচ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে নকল বা ভেজাল ওষুধ উত্পাদন ও বাজারজাত করলে কঠোর শাস্তি, এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত কার্যকর রয়েছে।
চিকিত্সকদের মতে, ওষুধের নামে এসব অবৈজ্ঞানিক পণ্য ব্যবহারের ফলে কিডনি বিকল, লিভার সিরোসিস, ক্যানসার ও ডায়াবেটিসসহ নানা অসংক্রামক রোগ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংকট চরমে পৌঁছেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রায়ই ধারণক্ষমতার তিনগুণ রোগী চিকিত্সাধীন থাকে। শুধু বাথরুম ছাড়া আর কোথাও শয্যা দেওয়ার জায়গা থাকে না।
সাত দিনে ডায়াবেটিস রোগী সুস্থ হয়ে উঠে। এমন প্রচারে চিকিত্সা সম্পর্কে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিটির প্রধান এবং বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, বিশ্বে এমন কোনো চিকিত্সা আবিস্কার হয়নি, যার সাহায্যে সাত দিনে ডায়াবেটিস রোগী সুস্থ হয়ে যাবে। এগুলো প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই না। তিনি বলেন, ডায়াবেটিস রোগ নিয়মিত চিকিত্সাসেবা বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী নিতে হয়। এই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নির্মুল করা যায় না। নিয়ম মেনে চললে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং সুস্থ সুন্দর জীবনযাপন করা যায়।
প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ ও কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, ফেসবুক ইউটিউবে প্রচারণা দেখে ওষুধ সেবন জেনে শুনে বিষ পান করার সামিল। অবৈজ্ঞানিক উপায় তৈরি করা গাছ গাছড়া, লতাপাতা ও আটা ও ময়দা দিয়ে কেমিক্যাল সংমিশ্রণে তৈরি ওষুধের নামে রোগী কী খাচ্ছেন তা তিনি নিজেও জানেন না। ডায়াবেটিস দূর হওয়া তো দূরের কথা, কিডনিসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে দ্রুত আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এন হুদা বলেন, অনলাইন ও ইউটিউবে যৌন ও শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেওয়া মিথ্যা প্রচার-প্রচারণায় সয়লাব। তরুণ-তরুণী, যুবক থেকে বৃদ্ধ লোকজন পর্যন্ত এই ধরনের প্রচারে প্রলুব্ধ হয়ে এগুলো ব্যবহার কিংবা সেবন করে। কিন্তু বার বার সেবনে তার সম্পূর্ণ যৌন সক্ষমতাই নষ্ট হয়ে যায়। এই ধরনের ফাঁদে পড়া রোগীরা প্রতিদিন তার কাছে চিকিত্সার জন্য আসছেন। তবে এসব অপচিকিত্সায় শারীরিক সক্ষমতা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। বরং স্থায়ীভাবে ডায়াবেটিসসহ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
নিউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেন, ডায়াবেটিস একটি বহুমাত্রিক রোগ। চিকিত্সা বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত ওষুধ নিয়মিত খেয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এ সকল রোগীর ব্লাড সুগার দ্রুত কমে গেলে কিংবা বাড়লেও ক্ষতি। চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিয়মিত ওষুধ সেবন করলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সুস্থ জীবন যাপন করে যাবে। সাত দিনের মধ্যে ডায়াবেটিস সারিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণ প্রতারণা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও শ্যামলী ২৫০ বেডের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ হাসপাতালের প্রধান ডা. আয়শা আক্তার বলেন, অপপ্রচার চালিয়ে নানা ধরনের ওষুধ বিক্রি করা চরম প্রতারণা। এই ধরনের ওষুধ নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকি।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ড. মো. আকতার হোসেন বলেন, অনলাইন ও ইউটিউবে প্রচার চালিয়ে ওষুধ বিক্রি করা বেআইনি কাজ। ঔষধ প্রশাসনের পক্ষ প্রায়ই অভিযান চালিয়ে এদের জেল জরিমানা করা হয়। তারপরও তাদের প্রচার-প্রচারণা বন্ধ হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিআইএসটিআইয়ের উপ-পরিচালক আবু সাঈদ বলেন, ৯৯০ টাকা ওষুধ খেয়ে সাত দিনে ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি। এই ধরনের অনলাইন ও ইউটিউবে প্রচারকারী কয়েক জনকে একাধিবার জেল জরিমানা করেছি। তাতেও ওষুধ বিক্রি বন্ধ হয়নি। অন্যদিকে, অপপ্রচার কিংবা প্রচার চালিয়ে ওষুধ বিক্রি অথবা চিকিত্সাসেবা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অন্যতম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। এই প্রতিষ্ঠানের রেজিস্টার ডা. মো. লিয়াকত হোসেন বলেন, অপপ্রচার ও প্রচার করে ওষুধ বিক্রি কিংবা চিকিত্সা বিএমডিসির আইনে অপরাধ। ইউটিউব ও অনলাইনে ডায়াবেটিস ওষুধ বিক্রয় ও চিকিত্সা প্রদানকারী ডা. জাহাঙ্গীরসহ কয়েক জনকে সতর্ক করা হয়েছে ইতিপূর্বে। তারপরও তারা একই কাজ করে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে একমাত্র ডা. জাহাঙ্গীর এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার। তাকেসহ অন্যদের বিএমডিসি থেকে আবারও নোটিশ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।